বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে রমজান ও নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রমজান শুরুর প্রায় এক মাস বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে নিত্যপণ্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে’ বলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাসকে অকার্যকর প্রমাণ করে সেগুলোর মূল্যবৃদ্ধি যে আরও গতি পাবে, তা অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কেন অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
যুগান্তরের ১৩ মার্চের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই রোজার উত্তাপ। ছোলা থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল, খেজুর, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, মুরগি, গরুর মাংস, গুঁড়া দুধ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। অসাধু সিন্ডিকেট গত দু’মাসে ধাপে ধাপে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। রিপোর্টে এসব পণ্যের বর্তমান দাম, দুই মাস আগের দাম এবং দুবছর আগে এ সময়ের দামের একটি তুলনামূলক বিবরণী দেওয়া হয়েছে।
এতে দেখা যায়, দুমাস আগের তুলনায় ১১ মার্চ এসব পণ্যের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ অনেক বেশি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটির ১৫ মার্চের এক প্রতিবেদনে ৩০ দিনের ব্যবধানে ১৪টি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, প্যাকেটজাত আটা, মাংস, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা। চাল, প্যাকেটজাত আটা ও পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫, ১ দশমিক ৬৫ এবং ৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। খাসির মাংস ও মুরগির দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ১৭ এবং ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর দ্য ডেইলি স্টারের ১৪ মার্চের এক রিপোর্টে গত এক মাসে চাল (মোটা ও সরু), ভোজ্যতেল, গরু ও খাসির মাংস এবং বিভিন্ন ধরনের মসলার দাম বৃদ্ধির তুলনামূলক বিবরণী দেওয়া হয়েছে।
এতে দেখা যায়, গত এক মাসে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা, আর সরু চালের দাম প্রতি কেজি ৫৮ থেকে বেড়ে ৬৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটার ১২৫ থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা এবং গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে বেড়ে ৫৭০ টাকায় পৌঁছেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এত হৈচৈ হয় কেন? এর কারণ হলো, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সব শ্রেণির মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে হতদরিদ্র্য, দরিদ্র ও নিুআয়ের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। প্রথমে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চালের কথায় আসা যাক। সরকারি হিসাবে একটি পরিবারে মাসিক যে ব্যয় হয়, তার কম-বেশি অর্ধেক চলে যায় খাদ্যপণ্য সংগ্রহে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬-এর রিপোর্ট মোতাবেক জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট খাদ্য বাবদ খরচের ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যশস্য (মূলত চাল) ক্রয়ে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চাল প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা আমাদের ২০১৭ সালে চালের নজিরবিহীন উচ্চমূল্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ওই বছর আগাম বন্যার কারণে বৃহত্তর সিলেটের হাওড়াঞ্চলে ১০ লাখ টন বোরো ফসল নষ্ট হওয়া এবং চাল আমদানিতে উচ্চহারে শুল্কারোপের কারণে অতি স্বল্প পরিমাণে চাল আমদানির ফলে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হয়; যা ছিল তখন পর্যন্ত মোটা চালের সর্বোচ্চ দাম। এ বছর মোটা চালের দাম ইতোমধ্যে ২০১৭ সালের দরকে ছুঁয়ে ফেলেছে।
সদ্য সমাপ্ত আমন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ লাখ টন কম চাল উৎপাদিত হওয়া, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের ব্যর্থতা, এই সেদিন পর্যন্ত সরকারি খাতে চাল আমদানি না হওয়া ইত্যাদি কারণে সরকারি গুদামে চালের মজুত তলানিতে নেমে এসেছে। চাল আমদানি শুল্ক হ্রাস করে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হলেও বেসরকারি খাতে চাল আমদানি কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি।
উপর্যুক্ত কারণসহ চালকল মালিক ও মজুতদারদের সিন্ডিকেশনের কারণে আগামী বোরো ফসল না ওঠা পর্যন্ত অর্থাৎ আগামী এপ্রিল মাস পর্যন্ত চালের দাম আরও বৃদ্ধি পাওয়া বৈ কমার সম্ভাবনা কম। আমিষজাতীয় খাদ্য যেমন-মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধিতে নিুবিত্ত ও নিুমধ্যবিত্ত পরিবারে এগুলোর সংগ্রহ হ্রাস পায়। এতে এসব পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে শিশু ও মহিলারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে।
খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে খাদ্যবহির্ভূত খাতে যেমন-পরিধেয় বস্ত্রাদি, বাড়িভাড়া, আসবাব ও গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহণ, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির ব্যয় মেটানো সাধারণ মানুষের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাদের কমিয়ে আনতে হয় শিক্ষা খাতের ব্যয়, যার শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। তাদের কমাতে হয় চিকিৎসা ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে এমন এক সময়ে যখন করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে দেশে কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন হ্রাস ও অন্যান্য কারণে মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং দেশে দারিদ্র্য হার বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারি করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ছুটিতে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক আয় হ্রাস পেয়েছে। বিবিএসের গত সেপ্টেম্বরের এক জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারির প্রভাবে মানুষের মাসিক আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ কমে গেছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক সাম্প্রতিক জরিপে উঠে আসা তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কেবল উৎপাদনমুখী খাতে কর্মরত ৫৮ শতাংশ শ্রমিকের আয় কমেছে। স্বকর্মস্থানে নিয়োজিত ৩৭ শতাংশ শ্রমিকের আয় এখনো করোনা-পূর্বের চেয়ে অনেক কম।
মানুষের আয় হ্রাসের প্রভাবে বেড়েছে দেশের দারিদ্র্য হার। গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত সানেমের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে; যা বিবিএসের হায়েস ২০১৬-এর চূড়ান্ত রিপোর্টে (মে, ২০১৯) দাঁড়িয়েছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে।
সানেমের এ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে গত বছর একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন- পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি), ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে উঠে আসে দেশে উচ্চ দারিদ্র্য হারের তথ্য। পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ জরিপে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে। আর সিপিডির জরিপে দারিদ্র্য হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশে।
গতানুগতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে এবারও হয়তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে (বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের) চিঠি দিয়ে বলা হবে, ‘একশ্রেণির ব্যবসায়ীর নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অপচেষ্টার’ বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীকে হয়তো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে দেখা যাবে।
ব্যবসায়ীরা বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা রাখবেন না। তাই রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপে নিষ্পেষিত হওয়া যেন এ দেশের ভোক্তাদের ভাগ্যের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিশ্রুতিতে জনগণ এখন আর আস্থা রাখেন না। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আসন্ন রমজান মাসে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে যুগান্তর পরিচালিত অনলাইন জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯১ দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোটদাতা মন্ত্রীর বক্তব্যের ওপর আস্থা রাখেননি।
সবশেষে বলতে চাই, খাদ্যশস্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকার তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। রমজানে বহুল ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপণ্যের দাম যেন সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় তা জনগণের, বিশেষ করে গরিব ও নিুআয়ের মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক