শহীদ আবু সাঈদ থেকে যে রক্ত গড়াতে শুরু করেছে, তা আর পেছনে ফিরবে না। শহীদ মুগ্ধের দরদের পানি মিশে গেছে তারই বুকের তাজা রক্তে। এই এক আরম্ভ, যা শেষ হয় না। এখনও মৃত্যু হচ্ছে ফ্যাসিস্টের গুলিতে আহতদের।
এমনকি আনসারদের প্রহারে আহত ছেলেটিও মারা গেছে। রুদ্ধশ্বাসে সহযোদ্ধার জানাজা পড়তে দাঁড়াচ্ছে বন্ধুরা। গাল ভিজছে অশ্রুতে, ঘাস ভিজছে, রাস্তা ভিজছে। অশ্রুর সেই নহর সারা বাংলাদেশের হাজারো পরিবারের ভেতর বয়ে যাচ্ছে। হাজারো আহত কিশোর-তরুণ হাসপাতালের বিছানায়। গণকবর আবিষ্কৃত হচ্ছে, লাশের স্তূপ জ্বালিয়ে দেওয়ার ভিডিও সহ্য করা যাচ্ছে না। এই শহীদদের আমরা ভুলতে পারি না, ভুলতে দেব না। যে বিপুল বিদ্রোহে বাংলাদেশ জেগেছে, তেমন বিপুল ভালোবাসায় আগলে রাখতে হবে সব শহীদের স্মৃতি। তাদের জন্য বুকের মধ্যে যেন কবরের মতো পবিত্র একটা জায়গা ধরে রাখি। বাংলাদেশ যা ঘটায়, তা ঘটে দক্ষিণ এশীয় স্তরে। ১৯৭১ সালেও তা সত্য, ২০২৪-এও তা সত্য।
এশিয়ার ঊরুসন্ধির এই দেশের ভেতরের ঘটনা একই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ঘটনাও। বাংলাদেশ সেই দেশ, যেখানে দশক চলে যায় কিছুই ঘটে না। আবার এটা সেই দেশ, যেখানে কয়েক সপ্তাহে আস্ত দশকই ফুরিয়ে যায়। দেড় দশকের দুঃশাসন শেষ হয়েছে জুলাই-আগস্টের শেষ তিন সপ্তাহে। কিন্তু এই রাজনৈতিক ভূমিকম্পের ধাক্কা অনুভূত হবে আগামী দশকেও।
এটা সেই দেশ, যেখানে কখন কোথায় জনবিস্ফোরণ ঘটবে, তা জানতে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক যন্ত্রপাতিগুলোর এখনও বাকি আছে।
অনেকে হয়তো এখনও বুঝতেই পারছেন না যে, ১৯৫২ সালের মতো একটা বিরাট জাগরণ শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্র বা রাজনীতি তা ধারণ না করতে পারলেও জাতীয় মানসে এই পরিবর্তন বহুদিন কাজ করে যাবে। হয়তো পাঁচ কিংবা সাত বছরে এর পূর্ণ চেহারাটা আমরা বুঝতে পারব। সে সময়ের পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র ভেবেছিল। এই সময়ের জনবিচ্ছিন্ন শক্তিগুলো ভাবছে, বাংলাদেশের শ্রাবণ বিপ্লব বোধ হয় ইসলামপন্থি আর আমেরিকার ষড়যন্ত্র। পৃথিবীর কোনো পরাশক্তির ক্ষমতা নাই, রাজনীতি থেকে সবচেয়ে দূরের সবচেয়ে মাসুমের সবচেয়ে তাজা প্রাণকে এ রকম অলৌকিক অবিশ্বাস্য আত্মদানে উজ্জীবিত করতে পারে। সমাজের ভেতর দানবীয় শক্তির ভয়াবহ নির্যাতন ও হত্যালীলার বিরুদ্ধে তিলে তিলে যে ঘৃণা ও সাহস সঞ্চিত হয়েছে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না; মানুষ হওয়া লাগে।
ভয়াবহ রকমের রক্তাক্ত ও দীর্ঘ সেই জুলাই, সেই শ্রাবণ এখনও শেষ হয় নাই। ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে এক দফা দিয়েছিল, মাত্র এক দিন পরেই তা পূরণ হয়। শেখ হাসিনার পলায়ন, বাকিরা আদাড়ে-বাদাড়ে। এই পর্বটি বরং সহজ। কঠিন ও জটিল পথটি এখন সামনে। ঐক্যের নিশান ধরে রেখে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের কঠিন পুলসিরাত পার হতে হবে বাংলাদেশকে। এক দফার জায়গায় সারাদেশে এখন শত শত দফা। সবকিছু বদলাতে হবে ঠিক; কিন্তু কোথায় শুরু করে কোথায় গিয়ে থিতু হবো– সেই প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি। একসঙ্গে সব চাইলেও হবে না, একসঙ্গে সব জায়গায় হাতও দেওয়া যাবে না।
একটা দেশ শুধু রাষ্ট্রের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। তা দাঁড়িয়ে থাকে তার সেরা কর্মনায়ক, ভাবুক ও দেশদরদিদেরও ওপর। রাষ্ট্রের উচিত নিজের স্বার্থেই এদের চিনে নেওয়া। এদের কাজের মঞ্চ এগিয়ে দেওয়া। খারাপ সময়ে খারাপ মানুষরা ভেসে ওঠে; ভালো সময় সেটাই যখন নাকি ভালো মানুষরা সামনে চলে আসে। এই মুহূর্তে জরুরি হলো মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলা। সংস্কারের রোডম্যাপ, অর্থনীতি পুনর্গঠনের নকশা, সংবিধান পুনর্লিখন অথবা সংস্কারের টাইমলাইন যখন মানুষের জানা থাকবে, তখন অনিশ্চয়তাও কমে যাবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত স্বার্থের কোনো দোহাই নাই, জাতীয় স্বার্থেই তাঁকে আমাদের দরকার হয়েছিল। তেমনি দীর্ঘদিন ধরে যারা নির্যাতিত হয়েও গণতন্ত্রের লড়াই জারি রেখেছিলেন, ফ্যাসিবাদকে অস্বস্তিতে রেখেছিলেন, তিলে তিলে কায়েমি শক্তিগুলোকে দুর্বল করছিলেন, তাদেরও দরকার হবে প্রধান উপদেষ্টার। এটা তো সেই দেশ, যেখানে সংকটকালে ১০ জন মিলে একজনকে রাজা নির্বাচিত করেছিল। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা না হয় সেই রাজা গোপালের ভূমিকাই পালন করলেন, দেশকে সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যস্থতা করলেন!
গণঅভ্যুত্থান সব মানুষকে একাকার করে ফেলেছিল। অধিকাংশ ‘আমরা’র থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল মুষ্টিমেয় ‘তোমরা’রা। কিন্তু এখন আবার যাতে সেই ঐক্য খণ্ড খণ্ড না হয়। হুঁশিয়ার, কারণ চক্রান্ত জারি আছে। বিদ্রোহের সংহতিকে এখন আমাদের সংস্কারের সংহতিতে পরিণত করতে হবে।
বিপ্লব বলুন বা সংস্কার– কাজটা তো দক্ষতার সঙ্গেই করতে হবে। প্রথম কাজ হলো, প্রতিবিপ্লবের পাওয়ার হাউসগুলো ভেঙে দেওয়া। তা করতে গিয়ে উৎপাদনশীল ব্যবসা, কারখানা, প্রতিষ্ঠানকে নড়বড়ে করে দেওয়া ভুল হবে। তার খেসারত দেবে দেশ। আবার মামলা-তদন্ত-বিচারে যেন কোনো বেইনসাফি না হয়। তারপরও আমরা মানুষ, ফেরেশতা নই। ভুল হলে সংশোধনের সুযোগ তাই দরকার।
ক্ষমতার পালাবদল যত দ্রুতই ঘটুক, প্রতিষ্ঠান বদলায় ধীরে। মানুষের চরিত্র বদলাতে কয়েক প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। তা ছাড়া পুরোনোরা রয়ে গেছে ডালে ডালে, লতায়-পাতায়। তাই সামনে এগিয়ে দিতে হবে তরুণদেরই। কেননা, তারাই পরীক্ষিত শক্তি। তারা স্বৈরাচার ঠেকিয়েছে, নৈরাজ্য-ডাকাত ঠেকিয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। তারাই কপাট খুলেছে বলে দেড় দশকের অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পেয়েছে সমাজ। এই সজাগ জনতার সমাজ সহজে কাউকে ছাড় দেবে না। দেশের দরকারে আবার জমায়েত হতে দ্বিধাও থাকবে না তাদের।
এখন আস্থা ফেরানোর সময়। সরকারের ওপর আস্থা ফেরানোর কাজ সরকারকেই করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভরসা জাগিয়ে রাখতে হবে। গত দেড় দশকের বিরাজনীতিকীকরণের দোষ কাটাতে নতুন রাজনৈতিক ভঙ্গি আর পরিষ্কার ইমেজ নিয়ে দাঁড়াতে হবে দলগুলোকে।
সবার আগে রাজনীতিবিদদেরই মতবাদ আর বৈদেশিক আনুগত্যের পন্থা থেকে বের হতে হবে। আমরা দেখেছি ভারতপন্থি ব্লক, আগে দেখেছি পাকিস্তানপন্থি ব্লক। মার্কিনপন্থি ও চীনপন্থি রাজনীতিও বাংলাদেশে অচেনা না। আরও কত কিসিমের মতবাদ ও পন্থায় জর্জরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু কোথায় বাংলাদেশপন্থা?
এই ছাত্র-তরুণরা সেই পন্থা হাজির করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী আত্মবিশ্বাস তাদের পুঁজি। কিন্তু তাদের মুক্তিযুদ্ধ অতীতচারী না, ব্যক্তিপূজারি না। তারা আধুনিক, গণতান্ত্রিক, উৎপাদনশীল ও মর্যাদাবান বাংলাদেশ চায়। আর নিজের দেশের সকল মানুষকে সমান না ভেবে, বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী ও মান্দি-সাঁওতাল-জনজাতি সবাইকে মুক্ত না করে দেশ কীভাবে মুক্ত হবে? এক জাতি এক সম্প্রদায়ের রাজনীতি করে কোনো দেশ কি সুখে আছে, দেখান? বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ঠিকঠাক কাজে লাগালে শক্তিশালী গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে এক দশকও লাগবে না। মোটামুটি একটা দশক যদি আমরা শান্তিতে কাটাতে পারি, কেউ আর আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। কারও বিরুদ্ধে না গিয়ে নিজের স্বার্থ বুঝে নেওয়ার এই বাংলাদেশপন্থাই আমাদের সহায়। এই সরল সত্যে পৌঁছানোর জন্য যেন আমাদের আর রক্তক্ষয়, দিনক্ষয়, লোকক্ষয় করতে না হয়।