সামাজিকমাধ্যমে ইবাদত নষ্ট হচ্ছে না তো

22

মুমিন জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। আর তা করতে হয় ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে। আল্লাহর দরবারে মুমিনের ইবাদত কবুল হলেই সে সফল। দুনিয়া ও পরকালের জীবনে সফল হওয়ার জন্য কবুলযোগ্য ইবাদতের বিকল্প নেই। তবে শিরক, কুফর ও নিফাকমুক্ত বিশুদ্ধ ইমান সব ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত। শুধু তাই নয়, উপরন্তু ইবাদতটি পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনোরকম উদ্দেশ্যের সামান্যতম সংমিশ্রণ থাকলেও সে ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের সব কৃতকর্ম নিয়ে আমি ধুলোর মতো উড়িয়ে দেব।’ (সুরা ফোরকান: ২৩)

Advertisement

গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইবাদত কবুলে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফেসবুক, লিঙ্কড-ইন, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ আরও নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রয়েছে। যেগুলো বর্তমানে প্রতিটি মানুষের নিত্যদিনের অন্যতম সঙ্গী। এসব যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে আমরা মুহূর্তের মধ্যে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন খবরাখবর পেয়ে থাকি এবং নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি ও আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁজ নিয়ে থাকি। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, আমরা কোরবানি, হজ, ওমরাহ, রোজা, সালাত ইত্যাদি ইবাদত করার সময়কার ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করছি অথবা এসব বিষয় উল্লেখ করে পোস্ট করছি। আমাদের ইবাদতের নিয়ত কিন্তু একমাত্র আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হলেও আমাদের অজান্তেই আমাদের ইবাদতগুলো আল্লাহর কাছে কবুল হচ্ছে না। অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কোরবানি করছি, মক্কায় গিয়ে হজ করছি, ওমরাহ করছি, জাকাত আদায় করছি। কিন্তু তার ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড দেওয়ার কারণে শুধু আমাদের সময় এবং টাকাগুলোই নষ্ট হচ্ছে, ইবাদতের সওয়াব আমরা পাচ্ছি না, এমনকি ফরজও আদায় হচ্ছে না। কারণ, ইবাদতে রিয়া থাকার কারণে তা আল্লাহর কাছে কবুল হচ্ছে না।

আমরা জানি না, আমাদের অজান্তেই এসব ছবি বা ভিডিও আমাদের কত বড় ক্ষতি করছে (অবশ্যই ছবি বা ভিডিও করে সংরক্ষণের জন্য রাখলে তাতে কোনো সমস্যা নেই)। কারণ, আমাদের অজান্তেই আমাদের ইবাদতগুলো রিয়া বা লোকদেখানো ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ইবাদত করা দেখে অন্য কেউ ভালো বলুক এরূপ মনোভাব নিয়ে ইবাদত করলে প্রকৃতপক্ষে সে ইবাদত আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় না। এ কারণে রিয়াকে রাসুল (স.) গোপন শিরক বলেছেন। রিয়ার শাব্দিক অর্থ হলো লোকদেখানো ইবাদত। রিয়া এমনি একটি মানসিক প্রবৃত্তি, যা নেক আমলকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। এজন্য কেয়ামতের ময়দানে শুধু রিয়াযুক্ত হওয়ার কারণে অনেক মানুষের আমল বরবাদ হয়ে যাবে। ইসলামের পরিভাষায় রিয়া বলা হয়, সমাজে লোকে ধার্মিক বলে আলাদা সম্মান করবে, কিংবা নিজেকে একটু ভিন্নভাবে লোকজনের কাছে উপস্থাপন করা যাবে, এ উদ্দেশ্য নিজেকে মানুষের সামনে আল্লাহ ভীরু, পরহেজগাররূপে প্রকাশ করা। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে রিয়ার অপকারিতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবাদতের মধ্যে একটি ধূলিকণা পরিমাণ লোকদেখানো মনোভাব থাকলেও আল্লাহতায়ালা ওই ইবাদত কবুল করবেন না। বরং এর জন্য শাস্তি অবধারিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রভুর দর্শন লাভের আশা রাখে, সে যেন নেক কাজ করে এবং তার ইবাদতে যেন অন্য কাউকে শরিক না করে।’ (সুরা কাহাফ: ১১০)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওইসব নামাজির জন্য ধ্বংস, যারা অন্যমনস্কভাবে নামাজ পড়ে এবং অন্যকে দেখানোর উদ্দেশ্য রাখে।’ (সুরা মাউন: ৪-৫)

সমাজে অনেক লোক এমন আছে যারা লোকদেখানোর জন্য আমল বা কাজ করে। তার কথা সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ুক, এ প্রত্যাশা করে এবং লোকেরা শুনে বাহবা দিক এ কামনা করে। বাস্তবে যদি কেউ এসব নিয়তে আমল বা কাজ করে, তবে সে শিরক তথা আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারত্বে নিপতিত হবে। এরূপ বাসনাকারী সম্পর্কে হাদিসে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করা হয়েছে। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের ওপর যা ভয় করি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে শিরকে আসগর বা ছোট শিরক। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল, শিরকে আসগর কী? তিনি বললেন, রিয়া (লোকদেখানো আমল), আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন রিয়াকারীদের বলবেন, যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেওয়া হবে, তোমরা তাদের কাছে যাও যাদের তোমরা দুনিয়াতে দেখাতে, দেখো তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাও কি না?’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য এবং মানুষের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করার জন্য কোনো আমল করে, আল্লাহতায়ালা তার অবস্থা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে, আল্লাহতায়ালা তাকে রিয়াকারীর শাস্তি দেবেন।’ (বোখারি: ২/৯৬২)

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, রিয়া অতি মারাত্মক একটি পাপ। ইবাদতের মধ্যে একটি ধূলিকণা পরিমাণ লোকদেখানো মনোভাব থাকলেও আল্লাহতায়ালা ওই ইবাদত কবুল করেন না। যে কোনো আমল আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য রিয়া বা লৌকিকতামুক্ত থাকতে হবে। মানুষকে দেখানো বা অন্য কোনো দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য হতে পারবে না। তবে কেউ না চাইতেই মানুষ তার ভালো কাজ বা ইবাদত দেখে প্রশংসা করলে সেটা লৌকিকতা বা রিয়া হবে না। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান-সদকা, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, পরোপকার, মানুষকে অর্থ-সম্পদ বা বিভিন্নভাবে সহায়তা করলে যদি কারও নাম ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এগুলোও রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না।

লেখক: এমফিল গবেষক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement