বীর চট্টলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য “আব্দুল জব্বারের বলী খেলা”

130

জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ই বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় বলী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বলীখেলা নামে পরিচিত। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।

Advertisement

দুই,
চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল। মুলত এই মল্লরাই এই বলিখেলায় বিরাট সময় জুড়ে প্রভুত্ব করেছিলো। তাদের দাপটে অন্য এলাকার বলীদের খেলায় জয়ী হওয়া দুরূহ ছিলো।

তিন,
তখনকার সময়ে বলী খেলা শুরুর পূর্বে বলীদের নৃত্য প্রদর্শন ছিলো অন্য রকম আনন্দের ও উপভোগ্য। যা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েও কিছুটা টিকে আছে এখনো। এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে। জব্বারের বলী খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলি খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলী খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলী খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী খেলা এখনও কোনরকমে বিদ্যমান।

চার,
এবারের আসর ১১৪ তম। ১৩ বৈশাখ ১৪৩০ বাংলা
২৫ এপ্রিল ২০২৩ইং মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। আর রানার্সআপ হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন চকরিয়ার জীবন বলী। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে হতে কোতোয়ালী মোড়, আন্দরকিল্লা মোড়, সিনেমাপ্লেস মোড় পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা। চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষেরা আবহমান কাল থেকে এই মেলা থেকে ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও তৈজসপত্র কিনে আসছে। যেমন বেতের পাটি, শীতল পাটি, মাদুরা, চাটাই, দা-বটি, রুটি তৈরির তাবা- বেলুনি, ফুলের ঝাড়ু, নারিকেল গাছের ঝাড়ু, হাতপাখা, মরিচ বাটার পাটা-উতা, তালগাছের পাখা, খাট-পালং, ইজিচেয়ার,বেত ও মাটির তৈরি নানান জিনিসপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। খাবারের মধ্যে চালের জিলাপি, রুটি, গজা, তিলের টকি, মুড়ির টকি, চিড়ার মলা,মুড়ির মলা, খৈ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও লাঙ্গল, ফলা, বরশি, গরম ও বর্ষাকালে মানুষের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র ছাড়াও গৃহস্থালি কাজের সবকিছুই পাওয়া যায় এই মেলায়। তাছাড়া ঘর সাজানোর নানা জিনিসপত্রের সমাহার। তাছাড়া নার্সারিতে বেশি বিক্রি হয় নারিকেলের চারাগাছ, আম-কাঁঠালের চারাগাছ হতে নানা জাতের ফুল ও ফলের গাছ। যা এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সেই সাথে মাছ ধরার জাল সহ নানা সরঞ্জাম। দেশ-বিদেশে আলোচিত এই মেলা চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলেও গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবকিছু এখনো টিকে আছে এই মেলায়। যেন গ্রামীণ ও প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই মেলা। করোনার পর আবারও স্বরুপে ফিরেছে সারা চট্টগ্রামের গর্ব এই খেলা ও মেলা। আউলিয়ার পূর্ণ্যভূমি চট্টলার মাটিতে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকুক এই মেলা। এই খেলা। সেই প্রত্যাশায় করি।

লেখক:সৌরভ প্রিয় পাল,
ছাত্রনেতা ও ক্রীড়া সংগঠক।

Advertisement