সারাদেশে বিশৃঙ্খলার পেছনে ইন্ধনদাতারা রয়েছে: সেনাবাহিনী

15

সম্প্রতি সারাদেশে চলমান বিশৃঙ্খলার পেছনে উদ্দেশ্যমূলক ইন্ধন দেখছে সেনাবাহিনী। তবে এই ইন্ধনদাতা কারা তাদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় সেনাবাহিনীর কাছে নেই।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সেনাসদর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল-স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান এসব তথ্য জানান।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, সেনাবাহিনীর পদক্ষেপের কারণে অনেক ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটছে না। যেগুলো ঘটছে সেগুলোও যেন থেমে যায় সেজন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে সেনাবাহিনী। তবে ছাত্র ও শ্রমিকদের মতো সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে যখন সেনাবাহিনীর শক্তি প্রয়োগের বিষয় আসে তখন অনেক চিন্তা করে এগোয় সেনাবাহিনী। সেজন্য হয়তো অনেকে মনে করতে পারেন যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের তথ্য জানিয়ে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, গত ১৩ নভেম্বর থেকে এই পর্যন্ত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনী মোট ২৪টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৩৬৫ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত মোট ১,৩২৮ জন ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর এই কাজের ধারাবাহিকতায় গত ২০ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর মোট ১২৩ জন সদস্য হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন অফিসার শহীদ হয়েছেন। নয়জন অফিসারসহ মোট ১২২ জন সেনাসদস্য বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৪০টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ১৮টি সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। শিল্পাঞ্চল ছাড়াও ৬৩ টি বিভিন্ন ধরণের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৬টি, সরকারী অফিস সংক্রান্ত একটি, রাজনৈতিক কোন্দল ৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের ঘটনা ৪০টি।

বৌদ্ধদের দেশব্যাপী কঠিন চীবরদান উৎসব, সনাতন ধর্মাবলম্বী মাতুয়া গোষ্ঠীর রাসমেলা ও নবান্ন উৎসব উদযাপনের জন্য নিরাপত্তা দিয়েছে সেনাবাহিনী। কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ যৌথ অভিযান গত এপ্রিল থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৭৯ জন কেএনএ সক্রিয় সদস্য ও সহায়তাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ মোট ৬০টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জামাদি (দূরবীন, ম্যাপ, আইডি সরঞ্জাম, ওয়াকিটকি, ইউনিফর্ম ইত্যাদি) উদ্ধার করা হয়েছে। সন্ত্রাসী সংগঠনটির পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণ এবং অতর্কিত হামলায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।

সনাতন নেতা চিন্ময় দাশ ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে সহিংসতা হতে পারে এরকম ধারণা থাকার পরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, মৃত্যুর ঘটনাটি অবশ্যই অনেক বেদনাদায়ক। আমাদের সার্বিক চেষ্টা থাকে যেকোনো ধরণের মৃত্যু প্রতিরোধ করার। কিন্তু আমাদের সক্রিয়তার কারণেই হয়তো অনেক বড় ঘটনা সেখানে ঘটেনি। আপনারা জানেন সেখানে বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় অনেক ছিল। সেই পরিস্থিতিতে কিন্তু সেখানে আরও খারাপ ঘটনা ঘটতে পারতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় কারণে সেরকম কিছু হতে পারেনি।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে অনেক পরে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা গেছে এবং তারা আসার পরেও তেমন ভূমিকা কেন দেখা যায়নি- জানতে চাইলে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, এই ছাত্ররাই কিন্তু আন্দোলন করে দেশের এমন একটা পরিবর্তন এনেছে। আমরা সবাই আশা করছি যে দেশটা একটা ভালো দিকে যাবে। ছাত্ররাই যখন কারও ইন্ধনে পরিস্থিতি না বুঝে সাময়িকভাবে ডিরেইলড হয়ে যাচ্ছে তখন তাদের বিরুদ্ধে আমরা যদি শক্তি প্রয়োগের কথা চিন্তা করি তখন আমাদের কিন্তু অনেক চিন্তা করে কাজটা করতে হয়। আমরা আশা করি ছাত্ররা বা সাধারণ মানুষ যারা আছে প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝবেন। আর সামাজিক মাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে কোনো উস্কানি এলে সবাই যেন যাচাই করার চেষ্টা করেন যে আসলে ঘটনাটি কী ঘটছে।

সেনাবাহিনীর অবস্থান থাকার পরেও অনেক ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষেত্রে আপনাদের গোয়েন্দা তথ্যের কোনো ঘাটতি আছে কী না জানতে চাইলে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, ঘাটতি আছে আমি বলবো না। ইন্টেলিজেন্সের বিষয়ে সবার সাথে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানে না এরকম কোনো ঘটনা হয়নি। যৌথবাহিনীর অভিযান চালাতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়েছে এরকম খবর শোনা যায়।

এরকম কতজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আছেন তারা অপরাধে জড়িয়েছেন এরকম ঘটনা হয়তো ঠিক না। তবে কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলোতে হয়তো সেনা সদস্য বা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আমার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন নেই। তবে যত অভিযোগ আসছে প্রত্যেকটার তদন্ত হচ্ছে, কিছু তদন্ত শেষ হয়েছে। আমার জানামতে এখানে পাঁচ বছরের থেকে শুরু করে এক বছরের জেল, চাকরি থেকে বরখাস্তসহ বিভিন্নরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ইন্ধনদাতা যাদের বলা হচ্ছে তারা আসলে কারা, তাদের বলার মতো কোনো পরিচয় আছে কী না এবং তাদের উদ্দেশ্য কী বলে এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে জানতে চাইলে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, তাদের আইডেন্টিটি এখন এক্সাকটলি বলতে পারবো না। বাট তারা কী চায় সেটা আপনি-আমি সবাই জানি। তারা দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। এটা এক ধরণের মোটিভ (উদ্দেশ্য) আছে এটা বলছি না, একেকজনের একেক ধরণের মোটিভ থাকতে পারে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ থাকতে পারে, সামষ্টিক স্বার্থ থাকতে পারে। এ ধরণের ইন্ধনদাতা থাকবেই, এটা শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতিতে না, যেকোনো দেশ যখন শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে থাকে তখনও এরকম অনেক ধরনের হতে পারে। একটা দেশ যখন চলে তখন অনেক রকমের বিষয় থাকে-ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক। ইন্ধনদাতারা সবসময় ছিল, থাকবে। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ জনতা তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ইন্ধনে প্ররোচিত না হওয়া।

Advertisement