উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ১২ বছরের নিরন্তর পরিশ্রমের ফসল : প্রধানমন্ত্রী

366

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণকে একটি ঐতিহাসিক গর্বের বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গত ১২ বছরের সরকার পরিচালনায় নিরন্তর পরিশ্রম এবং পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে আমাদের আজকের এই অর্জন।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের যে অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তা আমাদের বিগত ১২ বছরের নিরলস পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার ফসল। দেশের মানুষই এসব করেছেন। আমরা সরকারে থেকে শুধু নীতি-সহায়তা দিয়ে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তৃতায় একথা বলেন।

তিনি আজ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি এই সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সাংবাদিকরা পিএমও থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন।

জাতির পিতার ছোট মেয়ে ও প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণভবন প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা- এই তিনটি সূচকের ভিত্তিতে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের তিনটি মানদন্ডই খুব ভালোভাবে পূরণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ পুনরায় সকল মানদন্ড অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পূরণের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করলো।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের পর্যালোচনায় ২০১৯ সালে মাথাপিছু আয়ের মানদন্ড নির্ধারিত ছিল ১ হাজার ২২২ মার্কিন ডলার। ঐ বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮২৭ ডলার। আর বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার। অর্থাৎ মানদন্ডের প্রায় ১ দশমিক ৭ গুণ। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদন্ড ৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫ দশমিক ৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে উত্তরণের জন্য মানদন্ড নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। কিন্তু ঐ সময়ে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৭।

শেখ হাসিনা বলেন, এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।

তিনি এ সময় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ণের কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরে বলেন, ২০০৮-০৯ বছরে জিডিপি’র আকার ছিল মাত্র ১০৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ সালে তা ৩৩০ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, এই ১২ বছরে সরকারি ব্যয় ৪ দশমিক ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭ হাজার ৯৬০ কোটি থেকে ২০১৯-২০ বছরে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা হয়েছে। পাশাপাশি ২০০৮-০৯ বছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যেখানে ছিল ১৫ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ বছরে তা ৪০ দশমিক পাঁচ-চার বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ বছরের ৭ দশমিক চার-সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪ দশমিক শূন্য-তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০ দশমিক ৫ ভাগ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশে।

খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য় এবং মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।

তিনি বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯-১০ বছরের ৫,২৭১ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের দেশ পরিচালনায় মানুষের গড় আয়ু ২০০৯-১০ বছরের ৬৯ দশমিক ছয়-এক বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশামক ৬ বছর। ২০০৯-১০ বছরের তুলনায় ৫-বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেক কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে ২৮। মাতৃমৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে লাখে ১৬৫ জনে যা ২০০৯-১০-এ ছিল ২৮০ জনে।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ গণভবনে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ গতকাল (২৬ ফেব্রুয়ারি) স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি।

‘সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের। আমাদের এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটলো, যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন করছি; আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে।’

বাংলাদেশের জন্য এই উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি। এই অর্জনকে দেশের নতুন প্রজন্মকে উৎসর্গ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে। আমাদের এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এটি একটি বিশেষ ধাপ।

উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে।

জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত পাঁচ দিনব্যাপী এক বৈঠক শেষে এ তথ্য জানানো হয়। গত ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে এলডিসি স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের সুপারিশ করা হয়।

বৈঠকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সূচক পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণে সব ধরনের সূচকের অগ্রগতি হয়েছে।
এরআগে প্রধানমন্ত্রীর হাতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশপত্র তুলে দেন অর্থমন্ত্রী। এরপর প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেন।

মুজিববর্ষে সবার জন্য ঘর দেওয়ার কর্মসূচির কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল গৃহহীনদের ঘর প্রদান কর্মসূচির আওতায় ৮ লাখ ৯২ হাজার গৃহহীনকে ঘর দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৭০ হাজার ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৫০ হাজার গৃহ নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৬ পরিবারকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নারীরা আজ স্বাবলম্বী। জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ৭ম।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৮ লাখ ৫০ হাজার ৯৪০ জনকে প্রথম ডোজ করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তবে, টিকা দেওয়া হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়া এবং পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি তাঁর আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

টিকা গ্রহীতার তালিকায় যেমন সাধারণ মানুষ রয়েছেন, তেমনি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ রেহানা প্রথম টিকা নিলেও এখনও টিকা নেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি অবশ্যই টিকা নেব। তবে দেশের মানুষকে আগে দিতে হবে। আমার ৭৫ বছর বয়স। আজ আছি, কাল নেই। একটা টার্গেট করা আছে। সে পরিমাণ যখন দেওয়া হবে, তখন যদি টিকা থাকে, তাহলে তখন টিকা নেব।’

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফলতার পেছনে কোনো ম্যাজিক লুকিয়ে আছে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কোনো ম্যাজিকের কিছু না। যখন যেভাবে বলেছি, সবাই মেনে চলেছে। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করায় এটা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের সম্মিলিত ম্যাজিক।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘করোনা সারা বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছিল। জনগণের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে, আমরা যখন যেভাবে বলেছি, সবাই তা মেনে চলেছে। আমরা বিশেষ করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছি। মানুষের যেন কষ্ট না হয় সেটা দেখেছি। আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছি। সব শ্রেণির মানুষ সহায়তা পেয়েছে। তখনও গবেষণা চলছে, যখন আমরা আগাম অর্থ দিয়ে করোনার টিকা কেনার ব্যবস্থা নিয়েছি।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন গড়ে তুলেছি, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা দেয়াও আমাদের দায়িত্ব। কেউ যেন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে না জড়াতে পারে, সেজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা অপরিহার্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমালোচনা যারা করছে, তারা সবকিছু কি অনুধাবন করছে? আজকের এই দিনে আমি অন্য কিছু বলতে চাই না।

Advertisement