বিসিবি প্রেসিডেন্ট বক্সে ক্রিকেটারদের উলঙ্গ করা হয়: মাশরাফি

547

মাশরাফি বিন মুর্তজার বিদায় কি মাঠ থেকে হবে? দল থেকে তার বাদ পড়া ও বাদ পড়ার প্রক্রিয়া, তার অবসর না নেওয়া সংক্রান্ত বিতর্ক, বিসিবির ভূমিকা ও পেশাদারিত্বের সঙ্কট, সবকিছু নিয়েই মুখ খুললেন মাশরাফি। 

Advertisement

একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক বিস্ফোরক সব মন্তব্য করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের নানা বাস্তবতা নিয়ে। জবাব দিলেন তার বিরুদ্ধে থাকা কিছু অভিযোগ ও সমালোচনারও। আপনার অবসর সংক্রান্ত বিতর্ক ও বিসিবির নানা কিছু নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আপনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কথা বলছেন।

দল থেকে বাদ পড়ার এতদিন পরে কেন এবং এই সময়েই কেন?

মাশরাফি বিন মুর্তজা : কোনো না কোনো সময় তো চলেই আসে কথা। কোনো কারণ ছাড়াও অনেক সময় বলা যায়। আমার ব্যাপারটি হলো, আমার যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছে হচ্ছে, আমাকে বাদ দেওয়া বা আমার ফিটনেস, আমার বক্তব্য তখন আসেনি।

আমাকে যখন দলে নেওয়া হয়নি, অনেকেই (সংবাদমাধ্যম) তখন আমার কথা জানতে চেয়েছেন। আমি তখন স্রেফ এটুকুই বলেছি যে ‘এটা পেশাদার সিদ্ধান্ত, পেশাদারভাবেই দেখছি।’ কিন্তু পরে ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আমি দেখলাম, একেকজন (বিসিবির) একেকরকম স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন। মিডিয়া তো প্রশ্ন করবেই তাদেরকে। তখন উনারা সত্যি কথাটা বললে সমস্যা ছিল না।

প্রথম কথা, ফিটনেস। এই রেকর্ডগুলো নিশ্চয়ই উনাদের কাছে আছে, মাশরাফি কখনও ফিটনেস টেস্টে ফেল করেছে কিনা। কিংবা বলতে পারত যে মাশরাফির ফিটনেস টেস্ট এখন আবার নাও। সেটা না নিয়ে আপনি বলছেন যে, মাশরাফি ফিটনেসে ফেল করবে! এটা তো আমার জন্য অপমানজনক।

দ্বিতীয়ত, দল ঘোষণার সময় নান্নু ভাই (প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন) বলেছেন যে, মাশরাফিকে জানানো হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে মিথ্যা কথা বললেন। তার পর দেখলাম সুমন ভাইও (নির্বাচক হাবিবুল বাশার) একই কথা বলছেন। আমার এখন কী বলা উচিত!

বাদ দিয়েছে, এটা নিয়ে প্রশ্ন নেই। বাদ দেওয়ার পর আপনারা যে জিনিস প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন যে ২০২৩ বিশ্বকাপ সামনে রেখে নতুনদের সুযোগ দেওয়া, এটা খুবই যৌক্তিক। আমিও এখানে একমত। আমি তো ক্যারিয়ারের শেষ দিকে। কিন্তু এটা অপ্রত্যাশিত যে, এই যুক্তির সঙ্গে পরে উনারা এসব জড়িয়ে দিলেন ‘তাকে জানানো হয়েছে… তার ফিটনেসে সমস্যা।’

অথচ আমার ধারণা, যদি ফিটনেস টেস্ট নেওয়া হয়, যারা এলিট গ্রুপের ক্রিকেটার, ১৫-২০ জনের যে স্লট আছে, তাদের অনেকের থেকে বিপ টেস্ট বলেন বা ইয়ো ইয়ো, অনেকের থেকে আমার বেশি হবে (স্কোর)। আমি জানি, আপনি টেস্ট নিতেন! না নিয়ে এসব বলছেন কেন?

এসব দেখে আমার মনে হলো, লোকের কাছে সত্যটা যাচ্ছে না এবং এক পক্ষই কেবল বলে যাচ্ছে। নান্নু ভাই ও সুমন ভাইকে আমি এটা আগেই বলে রেখেছি, “এখন আমি কথা বলছি না। তবে মিডিয়া আমাকে প্রশ্ন করলে সত্যটা কিন্তু কোনো না কোনো দিন বলব।” তখন সুমন ভাই বলেছিলেন, “কেন, নান্নু ভাই তোকে বলেনি?” আমি বললাম, “আপনারা নাকি কম্বাইন্ডলি সিদ্ধান্ত নেবেন, তাহলে জানেন না?”

নান্নু ভাইকেও ফোন করেছিলাম। উনি বললেন, “না না, মিডিয়ায় আমি বলেছি, তোর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ (কথা) হয়েছে।” কিন্তু আপনিও জানেন, আমিও জানি, মিডিয়ায় নান্নু ভাই সৌজন্য সাক্ষাতের কথা বলেননি। বলেছেন যে “জানানো হয়েছে।” এটা তো পুরোপুরি মিথ্যে কথা।

আপনার বাদ দেওয়ার যে কারণ বলা হয়েছে, সেটা নিয়ে আপনার মত কি?

মাশরাফি : বাদ দেওয়ার কারণের সঙ্গে আমি একমত। বিশ্বকাপে যে পারফরম্যান্স করেছি, তার পর বাদ যাওয়ার কথা। বোর্ডকে একটা না একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হতো। হয় আমার ওপর আরও কিছুদিন আস্থা রাখতে পারত, অথবা বাদ দিতে পারত। বাদ পড়াকে আমি কোনোভাবেই অকারণ মনে করি না।

কিন্তু এটাও ভাবেন, তার আগের তিন সিরিজ আমি সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি (তিন সিরিজের দুটিতে)। একটা বিশ্বকাপ দিয়ে তারা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার মূল্যায়ন করেছে, এটা একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। আর কোথাও হয় না। ২০০৩ বিশ্বকাপে মাহেলা জয়াবর্ধনে ১৩ বা ২৩ রান করেছিল (৭ ইনিংসে ২১)। এরকম বহু ইতিহাস আছে, বিশ্বকাপ কারও না কারও খুব খারাপ গেছে।

তার পরও ধরে নিলাম ২০২৩ বিশ্বকাপ মাথায় রেখে বাদ দেওয়া হলো। কিন্তু বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া ঠিক হয়নি। কারণ আপনি মুখে বলছেন, ‘আমরা চাই, মাশরাফি মাঠ থেকে বিদায় নিক’, কিন্তু আপনার প্রক্রিয়া তো ঠিক নেই!

মাঠ থেকে আপনার বিদায় যদি না হয়, সেই দায় আপনাকেও দেন বোর্ডের অনেকে, ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকেও…

মাশরাফি : অবশ্যই বিদায় নেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু বিদায় কি কেউ দিতে চেয়েছে আমাকে? সঠিকভাবে কেউ বলেছে? আমাকে তো বাদ দিয়েছেন। বিদায়ের প্রস্তাব তো দেওয়া হয়নি!

করোনাভাইরাসের কারণে এক বছর খেলা হয়নি। এরপর বিদায়ের অফার পাওয়ার জন্য মাশরাফির যা যা করা দরকার ছিল, সব করেছে। দুই দফায় হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি থেকে ফিরে আমি চারটি টি-টোয়েন্টি খেলেছি, যেহেতু আর কোনো খেলা নেই। এক ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছি। আর কী করতে হবে?

হ্যাঁ, আমি মুখে বলছি, খেলা চালিয়ে যাব। সেটা তো বলতেই পারি। তারা কথা বলবে না আমার সঙ্গে? অন্তত বাদ দেওয়ার আগে তো খোলামেলা কথা বলবে! সেই কথা তো তারা বলেননি।

বিসিবি সভাপতি বা বোর্ড কর্তারা সংবাদমাধ্যমে অনেক কথা বলেছেন আপনার অবসর বা এসব নিয়ে। বরাবরই সরাসরি ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে তারা মিডিয়ার সামনে বলেন, এই সংস্কৃতি কিভাবে দেখেন?

মাশরাফি : ভালো তো, আপনারা অনেক নিউজ পেয়েছেন!

দেখেন, এটা অনেকটা এজেন্সির মতো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে যেমন আমরা ব্যস্ত থাকলে অনেক সময় এজেন্টরা কথা বলেন (স্পন্সরশিপ নিয়ে), আপনারাও এরকম। আপনাদের সেভাবে কাজে লাগাচ্ছে। বিসিবির এজেন্ট হিসেবে মিডিয়া আছে!

এটা তো সর্বোচ্চ অপেশাদার কিছু… পেশাদারীত্বের সবচেয়ে নিচু স্তরে অবস্থান এই ক্ষেত্রে। সব ক্ষেত্রেই… প্রতিটি কথা আগে মিডিয়ায় বলা হয়।

আপনি যখন কথা বলেন, পারফরম্যান্স আশা করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের, আপনার আচরণও তো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হতে হবে! পেশাদারীত্বও তো অন্যান্য দেশের মতো হতে হবে! সেটাও তো কোনোভাবে পাওয়া যায়নি।

আপনি বলতে চাইছেন, মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয় ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে?

মাশরাফি : একটা কথা… আগে বলা হয়নি। আমার যতটা খারাপ লেগেছে, ক্রিকেটে যদি কোনোদিন কষ্ট পেয়ে থাকি, এই একটা জিনিসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি। তখন আমি বুঝেছি, অন্যান্য ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে কত কী হয়েছে বা হতে পারে কিংবা হয়। আগে আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি। করতে চাইওনি। কিন্তু আমি যখন জানতে পারলাম… যেসব মিডিয়ায় ফোন করেছে, ইংল্যান্ডে বসে (বিশ্বকাপের সময়) আমাদের বোর্ড পরিচালকদের দুজনের তথ্য আমি জানি, কোনো কোনো (টিভি) চ্যানেলে ফোন করে তারা বলেছেন, “এটিই সুযোগ, আমাদের সামনে সুযোগ আসছে। মানুষের সামনে মাশরাফিকে কালার করে দেন, ভিলেন বানিয়ে দেন।”

খারাপ খেলার কারণে ভিলেন তো এমনিতে হয়েই আছি। তখন তো ক্রিকেট বোর্ড আমার পাশে দাঁড়াবে! পাশে দাঁড়িয়েও তো সুন্দরভাবে বাদ দেওয়া যেত আমাকে। এটা ভাবতে পারত যে ছেলেটা অন্তত কিছু না কিছু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য। দর্শক অনেক কিছু বুঝবে না, মিডিয়া অনেক কিছু জানবে না যে ভেতরে কত ইতিহাস, কত গল্প আছে।

আমি উনাদের নাম বলব না, দুজনের নামই জানি। আরও আছে কিনা আল্লাহ জানেন। তারা বিভিন্ন মিডিয়ায় ফোন করে বলেছেন, “সুযোগ আসছে, মাশরাফিকে নিয়ে নিউজ করে দেন। বাদ দিয়ে দেবে।”

তারা (ওই মিডিয়াগুলো) আমার প্রতি হয়তো সদয় হয়েছিল। আমাদের কোনো কোনো ক্রিকেটারদের জানিয়েছেন তারা। তার পর দলে এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ছেলরা ভীতু হয়ে গিয়েছিল যে মাশরাফিকে নিয়ে এটা হতে পারলে আমাদের ক্ষেত্রে কী হতে পারে!

আমি বিশ্বাস করি, যে মিডিয়াগুলোয় তারা এসব করেছেন, উনারাই একদিন এসব বলবেন। কারণ সত্যি কখনও আটকে রাখা যায় না। অন্যায় করলে আল্লাহ বিচার করেন। একজনের বিচার এর মধ্যেই হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অনেক কিছু হয়ে গেছে।

বাদ দেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে, সম্মানহানী করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি।

আপনাকে নিয়েও বোর্ড কর্তাদের অনেকের, ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকের অভিযোগ আছে যে দলের খবর বাইরে দিতেন!

মাশরাফি : কোনটা বলেন? আমি কয়েকটার কথা শুনেছি। একটি আছে, সাইফ উদ্দিন যখন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে (২০১৯ বিশ্বকাপে) ম্যাচ খেলল না পিঠের চোটের কারণে (একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, ভয়ের কারণে খেলেননি সাইফ)। পরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে যখন বিদায় নেব (নেতৃত্ব থেকে), সাইফ এসে বলল যে, “ভাই, এরকম একটা নিউজ হয়েছিল। আপনি বলেছিলেন…।” আমি বললাম, “তোর এটা বিশ্বাস হয়?” ও বলল, “আমাকে সিনিয়র একজন ক্রিকেটার বলছেন। বোর্ড থেকেও বলছে। সাংবাদিকরাও কয়েকজন বলেছেন।”

আমি তখন ওর সামনেই ওই রিপোর্টারকে ফোন করলাম। হয়তো এসব বলা ঠিক নয়, তবু বলছি। ওই রিপোর্টারকে ফোন করে বলি, “ভাই আপনি একটু বলেন তো কে নিউজটা দিয়েছিল? আজকে অন্তত সত্যি কথাটা বলেন। একটা বাচ্চা ছেলে, ৬-৮ মাস ধরে একটা ভুল ধারণা নিয়ে আছে।” রিপোর্টার তখন বললেন, আমাদের একজন নির্বাচক এটা বলেছেন। আমি সাইফকে শুনিয়েছি (লাউড স্পিকারে)। সাইফ তখন বলল, “ভাই দেখেন, সিনিয়র একজন ক্রিকেটারও আমাকে আপনার কথা বলেছিল!”

তামিমের একটা নিউজ একবার পত্রিকায় এসেছে। তখনও আমি রিপোর্টারকে ফোন করে স্পিকারে দিয়ে শুনেয়েছি ওকে। যেহেতু আমি অধিনায়ক, ক্রিকেট বোর্ডে গোপনীয় আলোচনায় অধিনায়ক অনেক সময় থাকে, দায় আমার আসে। কিন্তু ওখানে যে আরও মানুষ থাকে, তারা যে লিক করতে পারে… !

এরপর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিবের একটি নিউজ এসেছিল… । ৬০ বলে ১২৩ দরকার ছিল আমাদের। রিয়াদ তখন একটু সেট হতে চেয়েছিল। সাকিব পরে বলেছে, “ভাই, এভাবে খেললে কিভাবে হবে? যতোই থাকুক, আমাদের জেতার জন্য খেলতে হবে, চার্জ করতে হবে।”

এই কথাটা আমি টিম মিটিংয়ে বলেছি। সাংবাদিকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখনও বলেছি, “সাকিব একটু চেতছে এইটা নিয়ে।”

পরে আপনারা অনেকেই দেখেছেন, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে প্র্যাকটিসে রিয়াদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলছিলাম। রিয়াদ সব জানে। এই বক্তব্য আসার পর রিয়াদ নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়া দেখাত। কিন্তু সে সত্যটা জানে। সাকিবও জানে, সে কী বলেছে। আমি তো মিডিয়ার সামনেও বলেছি। এখন যদি আমি বলি এই যে বিভিন্ন মিডিয়ায় ফোন করে বলা হয়েছে, এটাও এই ঘটনার অংশ কিনা, কে জানে!

এবং আমি যে কথাগুলো বলেছি, সব আসেনি। আমিই একমাত্র, মিডিয়ায় এটাও বলেছি, বিশ্বকাপে যদি সাকিব অধিনায়ক থাকত, এই দলটা সেমি-ফাইনালে খেলত। বিশ্বাস করি বলেই বলেছি। মিডিয়ার ৮-১০ জন ছিল সেখানে। সাকিবকে নিয়ে যে ভালো কথাটা বললাম, সেটা তো আসলো না!

এভাবে অনেক সময় অনেক প্লেয়ারও আমাকে ভুল বুঝেছে। এখন কেন, কয়েকদিন আগেই সাকিব একটা মন্তব্য করেছে যে দলের কথা বাইরে আসে কিভাবে। এখন তো মাশরাফি নেই, বাইরে আসে কিভাবে? আমি এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।

এরপর আরও অনেক কথাও আসবে। এজন্যই আমি এসব বলছি যে, কেউ আছে, ‘স্পাই’ হিসেবে করে। একজন নয়, কয়েকজন আছে। স্বার্থ উদ্ধারের বিষয় নয়, তারা মানুষকে তেলবাজি করার জন্য, বোর্ডের কাউকে খুশি করে একটা জায়গায় যাওয়ার জন্য, কিংবা অভ্যাসগতভাবেও করে। দেখা গেল সে নিজের বউ-বাচ্চার সঙ্গে কথা বলতে গেলেও মিথ্যা বলে।

এটা একটা রোগ। এসব রোগের লোকও এখানে বসে আছে।

২০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন, নানা দেশে গেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন। বোর্ড পরিচালকদের এভাবে সামনে আসতে দেখেছেন কোনো দেশে?

মাশরাফি : কোন দেশে কে আছে, কখনও জানিও না। ২০ বছর খেলেও জানি না। বিদেশে গেলে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এলেও অন্তত জানার কথা যে বোর্ড পরিচালক কারা বা বিভিন্ন কমিটির দায়িত্বে কারা। তারা তো ওই জায়গায়ও আসে না। আপনারা হয়তো সাংবাদিকতার জন্য দু-একজনের কথা জানতে পারেন। বাংলাদেশে পরিচালকদের কথা সবাই জানে। আমার ধারণা, পাপুয়া নিউ গিনির মানষও জানে।

এই যে বোর্ড পরিচালকরা বোর্ডের খরচে দলের সঙ্গে বিদেশে যায়, বড় বড় টুর্নামেন্টে ঝাঁক ধরে যান, তারা দলে কতটা ভূমিকা রাখেন?

মাশরাফি : লাভ যতটুকু হয়, মাঝেমধ্যে দু-একটি ডিনার তারা করান (হাসি)। এছাড়া লাভ ক্রিকেটারদের নেই। ক্রিকেটাররা জানেন, আমার ক্রিকেট আমারই খেলতে হবে। তবে এইটুকু তারা জানে, পারফর্ম না করতে পারলে এরা কী করতে পারে! ভয়ের জায়গা বরং থাকে।

তামিমের ক্ষেত্রে ২০১৫ বিশ্বকাপে একই হয়েছে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে একদিন আগে, তামিম পুরো রাত ধরে কান্নাকাটি করেছে। এটা তো ওপেন সিক্রেট, অনেকেই জানে। এরকম ঘটনাই বরং আছে।

পাশে দাঁড়ানো এক জিনিস, না দাঁড়ানো আরেক জিনিস। উনারা যখন কথা বলেন, মনে হয় যে আমাদের কানে এগুলো আসে না। আমার কথা হলো, এসব বলতে হলে সামনেই বলেই! সমাজের ভেতর না ছড়িয়ে সামনে বলেন।

তাদের তো ভাবতে হবে, “এই ক্রিকেটারদের জন্যই আমরা এখানে বসে আছি।” এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। ক্রিকেটাররা খেলছে বলেই আপনারা ওখানে বসে আছেন। তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া আপনার দায়িত্ব। আপনাকে কে সম্মান করল, না করল, এটা দেখার দায়িত্ব আপনার নয়!

তার পরও আমি দেখিনি, কোনো ক্রিকেটার কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। বোর্ড পরিচালক তো বহুদূর, কর্মচারদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে না। একতরফা ক্রিকেটাররাই শুধু কথা শোনেন।

ক্রিকেটারদের সমালোচনা করা কি তাহলে বাজে দৃষ্টান্ত?

মাশরাফি : দর্শক সমালোচনা করলে বাজে দৃষ্টান্ত নয়। মিডিয়া করলে বাজে নয়। এটাই তাদের কাজ। মিডিয়ায় লেখা দেখে কোনো ক্রিকেটার বিচলিত হয়ে পড়লে তার খেলাধুলা করাই উচিত নয়। ঘরে বসে থাকা উচিত। কিন্তু বোর্ড যখন ঢালাওভাবে ক্রিকেটারদের সমালোচনা করবে, তখন অবশ্যই আমি ক্রিকেটারদের পক্ষে দাঁড়াব।

কেন দাঁড়াব? বলছি। শচিন টেন্ডুলকার, সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার, তাকে নিয়েও লেখা হয়েছে ‘এন্ডুলকার।’ এটা মিডিয়া লিখেছে। শচিন কি মিডিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে? নাহ, তিনি শান্ত ছিলেন। ক্রিকেট বোর্ড ওই সময় তার পাশে থেকেছে। নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে দশটা মিটিং হয়েছে। দশবার তার সঙ্গে কথা বলেছে। অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু ওই মিটিংয়ের খবর কি মিডিয়ার কাছে গেছে? যায়নি। এটাই পেশাদারীত্ব।

মিডিয়া প্রশ্ন করবেই। আপনার উত্তর দিতে হবে কেন? সব বিষয়ে কেন কথা বলতে হবে! মুস্তাফিজ কেমন বোলিং করেছে, এই মতামত দেওয়া জন্য ক্রিকেটের লোক আছেন, টেকনিক্যাল লোক, কোচ আছেন। আপনার কেন কথা বলতে হবে? বেশি কথা বললেই সমস্যা বেশি হয়।

প্রায়ই আপনারা শোনেন যে ক্রিকেটারদের পরিবার, (সফরে দলের সঙ্গী হয়)… ক্রিকেটারদের পরিবারকে কি বোর্ড টাকা দিয়ে নেয় নাকি? পরিবারকে ক্রিকেটাররা নিজেদের টাকায় নেয়, ফ্রি নয়। পরিবারের জন্য বাড়তি ভাতাও দেওয়া হয় না। বরং ক্রিকেট বোর্ড থেকে যারা সফরে যায়, তারা ৫০০ ডলার করে ভাতা পায় বলে শুনেছি। সেখানে ক্রিকেটাররা ট্যুর ফি ও অন্যান্য মিলিয়ে পায় হয়তো ১০০ ডলার (দৈনিক)। আপনি আছেন কোথায়? যাদের কারণে আপনি আরাম-আয়াশে আছেন, তাদেরকেই মাটিতে নামিয়ে দিচ্ছেন!

তার মানে কি ক্রিকেটারদের ঠকানো হচ্ছে?

মাশরাফি : বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে বেতন পায়, কোনোভাবেই তা… আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেলানোর দরকার নেই। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারবে যে পারফরম্যান্সও ওই পর্যায়ের হতে হবে। কিন্তু যে পর্যায়ের ক্রিকেট আমরা খেলি, সেই পর্যায়ের সঙ্গে এই বেতন কোনোভাবেই মেলে না। না জিতলে, বেতন দেবেন না, এটা কোনো কথাই হতে পারে না। জেতার কারণ হতে পারে বেতন বাড়ানো, একজন খেলোয়াড়ের নিবেদনের পর্যায় যে বেড়ে যেতে পারে… তা না হলে অফিসে আপনি ভালো করলে প্রমোশন দিত না। এটা সিম্পল ব্যাপার। ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মেলানোর প্রয়োজন নেই। তবে মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড তো মেইনটেইন করতে হবে!

আজকে টেস্ট ক্রিকেট খেলার মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে অনেকের। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলে না কেন অনেকে? ফার্স্ট ক্লাস খেলতে গিয়ে… ভ্রমণ করতে হয় বাসে। এক-দুই বছর হলো প্লেনে নেওয়া শুরু করেছে। দুই খেলার মধ্যে বিরতি রাখেন তিন দিন। বর্ষাকালে খেলা রাখেন। একদিন অনুশীলন করেই চারদিনের ম্যাচ খেলতে হয়। ছোটখাটো চোটে পড়ে। তখন তারা আর খেলতে চায় না। কারণ চারদিনের ম্যাচে বড় ইনজুরিতে পড়লে বিপিএল, ঢাকা লিগ মিস হয়ে যাবে। ওখানে তো টাকা বেশি!

এখন আপনি বলতে পারেন, টাকার জন্য ক্রিকেট খেলেন? উত্তর হলো, আপনি টাকার জন্য চাকরি করেন কেন? আপনার অফিস দারুণ সম্মান করলেও কেন বেশি সম্মানী পেলে অন্য অফিসে চলে যান? শুধু ক্রিকেটারদের দোষ!

আমি যেটা বলতে চাইছি, পেশাদারিত্ব আরও আনার জন্য, দায়বদ্ধতা বাড়ানোর জন্য বা দায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এই লেভেলগুলোকে বাড়াতে হবে। একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশে পারিশ্রমিক কখনোই ৫০ হাজার হতে পারে না (প্রথম শ্রেণির ম্যাচে)।

ক্রিকেটারদের আন্দোলন হলো না? তারপর কেবল সিনিয়র ক্রিকেটারদেরই বেতন বাড়ে। নিচে যারা থাকে, তাদের বাড়ে না। সবাই জানে, ওই ৫-৬ জন ছাড়া আন্দোলন হয় না। দিন শেষে আমাদের জুনিয়র ক্রিকেটাররা বা ক্লাব ক্রিকেটাররা যেখানে থাকার, সেখানেই পড়ে থাকে।

ক্রিকেটারদের তো প্রায়ই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। সিস্টেম যারা গড়েন ও চালান, বোর্ডের বিভিন্ন বিভাগ ও কমিটির দায়িত্বে যারা, তাদের দায়বদ্ধতা কি আছে কোথাও?

মাশরাফি : অবশ্যই দায় নেওয়া উচিত। মাঠ ভালো না থাকলে, মাঠের দায়িত্বে থাকা লোকের দায় নিতে হবে। আজকে একজন ক্রিকেটার হুট করে একটা কথা বললে মিডিয়া কমিটির দায়িত্বে যে আছে, তাকে দায় নিতে হবে। এইচপি বা ‘এ’ দলের সমস্যা হলে দায়িত্বপ্রাপ্তকে দায় নিতে হবে।

একমাত্র গেম ডেভেলপমেন্ট আমি দেখছি যে রানিং প্রসেসে আছে। কারণ ওই পরিচালক সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে নেই, সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ)। আমাদের সমাজে যে কাজ বেশি করে, সে বেশি গালি খায়। আজকে বায়ো-বাবলে যে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হলো, তার আগে তিন দলের ওয়ানডে টুর্নামেন্ট হলো, সর্বোচ্চ কৃতিত্ব সুজন ভাইয়ের। উনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে, কেউ সুজন ভাইয়ের অবদানের কথা বলবে না। বরং মিডিয়ার সামনে গিয়ে বলবে, ওর এত কথার দরকার কি? কিন্তু উনিই তো সিস্টেম গড়েছিলেন। বিপিএল খেলতে না দিয়ে কক্সবাজারে রেখে একটা দলীয় সমন্বয় গড়ে তুলেছেন। ভালো ভালো সিদ্ধান্ত নিলে কিন্তু ফল ঠিকই মিলেছে।

সুজন ভাইকে কারা কালারিং করছে মানুষের সামনে? তার নেগেটিভ তথ্যগুলো মিডিয়ার কাছে কারা দিচ্ছেন? এটা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। কারণ, আমি নই শুধু, যে কোনো ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করুন। সুজন ভাই তো আমার আত্মীয় নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রিকেটার-কোচকে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে যে একমাত্র আস্থার জায়গা উনি, যার কাছে কিছু বলা যায় যে আমার এই সমস্যা, ওই সমস্যা। বলার আর কোনো জায়গা নেই।

সে ওই খেলোয়াড়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন মিডিয়ার সামনে এসব চলে আসে আর তিনি গালি খান সে সুজন এমন। কিন্তু আমরা ক্রিকেটাররা এই বেচারাকে সবসময় দাড়িপাল্লার একটা পাশে রাখি। কোনো ক্রিকেটার সুজন ভাইকে নিয়ে কিছু বলবে না।

ভুল-ত্রুটি আছেই। এসব নিয়েই মানুষ। কিন্তু উনিই একমাত্র, যিনি কাজ করেন। অফিস করেন। সারাদিন ক্রিকেট ধ্যানজ্ঞানে রাখছেন। সারাদিন মোবাইল, ল্যাপটপে ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকেন। তার ফলও গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ পাবেন। তার ফল মিলেছে। বিশ্বকাপ জয়ের পর তো ওই বিভাগকে নিয়ে আর প্রশ্ন থাকে না। এর চেয়ে বড় কিছু তো নেই।

বিসিবি প্রেসিডেন্ট বক্স নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। আপনাদের ধারণা কতটুকু আছে?

মাশরাফি : প্রেসিডেন্ট বক্সে আসলে একজন ক্রিকেটারকে উলঙ্গ করা হয়। পুরো উলঙ্গ করা হয়। এটা উনারাও জানেন। উনারা অস্বীকার করতে পারবেন না। ওখানে আমাদের মানুষরাও থাকেন। ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ভালো সম্পর্কের মানুষও থাকেন। আমরা শুনি।

প্রেসিডেন্ট বক্সে যখন বলা হয়, ‘ওই প্লেয়ার চলে না’, তখন ওই প্লেয়ার আর চলেই না। যেখানেই ভালো খেলুক আর চলে না।

ক্রিকেটারদের কানে না আসলে আমরা জানলাম কোত্থেকে? অন্য কেউ কথা বলছে না এখন। আমার মতো কেউ ছেড়ে আসুক, তখন সেও বলা শুরু করবে। কারণ সে জানে কোড অফ কন্ডাক্ট আর নাই। মিলিয়ে দেখবেন তখন।

বোর্ডের যারা ক্রিকেটারদের নিয়ে এসব বিশ্লেষণ করছেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট নিয়ে তাদের ধারণা কেমন?

মাশরাফি : বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে এমন মানুষ কারা আছেন, যে ক্রিকেট খুব বোঝে? কজন আছেন এরকম মানুষ, আপনি আমাকে দেখান!

এমন মানুষও ড্রেসিং রুমে ঢুকে আমাদেরকে অর্ডার করেন, আমাদের ক্যারিয়ারের ১০ বছর হওয়ার পরও যাদের আমরা ক্রিকেটে দেখিনি। আমাদের সঙ্গে বোল্ডলি কথা বলেন তারা। আমি তো ২০০১ সালের খেলোয়াড়। আতহার ভাই তখন অবসর নিলেন। এছাড়া সব সিনিয়র ক্রিকেটারের সঙ্গে আমি খেলেছি, আকরাম ভাই, বুলবুল ভাই, মনি ভাই, রফিক ভাই, এমন কোনো ক্রিকেটার নেই, যাদের সঙ্গে খেলিনি। তখন থেকেই দেখে আসছি। যারা ক্রিকেট বোঝে, তারা অনেকেই নাই। যারা বোঝে না… তাদের নিয়ে এমনিতে সমস্যা নেই। বোর্ডের সুবিধা হলে যাকে খুশি নিতে পারে। কিন্তু তারা যখন বড় বড় কথা বলে, তাদের ছাড়া কাজ হবে না বলে, তাদের দেখে কষ্ট লাগে, এরা তো কোনোদিন ক্রিকেটই খেলেনি!

এই মানুষগুলি ড্রেসিং রুমে ঢুকে, মাঠে ঢুকে বা বিসিবিতে যখন … এমন ভাবে কথা বলে, তখন নিজের কাছে মনে হয়, নিজের জুতো বেঁধে গলায় নিয়ে হেঁটে বেড়াই। এছাড়া আর বলার কিছু থাকে না। এই মানুষগুলি যখন আমাদের নিয়ে সমালোচনা করে, তখন মনে হয়, ক্রিকেট না খেলে, তেলবাজি করে বেড়ালে আমার জীবনে অনেক ভালো কিছু হতো।

জাতীয় দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে কেমন দেখছেন?

মাশরাফি : সে তো দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বরখাস্ত হয়েছিল, তাই না? বাদ দিয়েছিল। ঝামেলার জিনিসকেই আমরা আমাদের এখানে ঢুকিয়ে রেখেছি!

আপনি সৌম্যকে পরিকল্পনা করাচ্ছেন সাতে খেলাবেন। রিয়াদকে ছয়ে খেলিয়ে তাকে ম্যানেজ করতে পারছেন না। শান্ততে তিনে খেলানোর জন্য সাকিবকে চারে নামিয়ে দিচ্ছেন। সৌম্যকে স্রেফ খেলানোর জন্য সাতে খেলাচ্ছেন। এটা তো কোনো পরিকল্পনা হলো না!

শান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, ভালো কথা। তরুণ ক্রিকেটারের পাশে থাকতেই পারেন। তাহলে সৌম্যকে বাদ দিন। জোর করে অন্য জায়গায় তো খেলানো জরুরি নয়! শান্ত পারফর্ম না করলে আবার সৌম্যকে নিয়ে আসেন! ম্যান ম্যানেজমেন্টও আপনি ঠিকমতো করতে পারেন না।

প্রশ্ন হচ্ছে, ফলাফল নিয়ে। বাংলাদেশ যদি সেমি-ফাইনাল খেলত (২০১৯ বিশ্বকাপে), মাশরাফিকে নিয়ে কোনো কথা হতো। আর এই কোচ… তুমি আফগানিস্তানের কাছে টেস্টে হেরেছো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুটি টেস্টে হেরেছো সি গ্রেডের টিমের সঙ্গে, তোমাকে নিয়ে আদর করবে নাকি? আমার ক্ষেত্রে আমি সহজভাবে নিয়েছি, তাকেও নিতে হবে।

সমস্যা হলো, যে-ই বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসে, তাকে আমরা এমন গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দেই, তার পা আর মাটিতে থাকে না। দেশি কোচের ক্ষেত্রে তা করি না। সুজন ভাই যখন কোচ হয়ে শ্রীলঙ্কায় গেলেন, তার সঙ্গে এখন পার্থক্য কোথায় হচ্ছে? তিনি তিন ম্যাচ হেরেছিলেন, এখানেও তো হারছেই। পার্থক্য কোথায়? এই কোচ কি করেছেন?

আমি শুনি যে কোচ নাকি বলছেন, ‘আমাকে স্যাক করুক, সমস্যা নেই।’ কারণ, সে তো জানেই, বরখাস্ত করলে পুরো এক বছরের টাকা নিয়ে চলে যাবে। চুক্তি তো ওরকমই। সে আবার সমানে ছুটি কাটাতে পারবে। ফ্ল্যাট সাজানো-গোছানো, সব সুযোগ-সুবিধা আছে। আমাদের দেশি কোচ না খেয়ে মরে যাচ্ছে। অথচ সারাটা বছর একজন কৃষকের মতো তারা মাঠে খাটেন। বাবুল ভাই, সালাউদ্দিন ভাই, সুজন ভাই, সোহেল ভাই, মুর্তজা ভাই, রাজিন সালেহ, আফতাবরা আসছে এখন, কারও দামই নাই।

ডমিঙ্গো হাই পারফরম্যান্স দলের দায়িত্ব নিতে চাইলেও তাকে জাতীয় দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে একটা কথা শোনা যায়। কোচ নিয়োগ দেওয়ার আগে কি আপনার বা সিনিয়র ক্রিকেটারদের মতামত চাওয়া হয়েছিল?

মাশরাফি : বিশ্বকাপ চলার সময় একাদশে কে খেলবে, এটার মিটিংয়েই তারা পারলে অধিনায়ককে রাখে না। আপনি বলছেন বিশ্বকাপের পর কোচের ক্ষেত্রে মতামত নেবে…!

দেখেন, কোচকে নানা কারণেই বাদ দিতে পারে। চন্দিকা হাথুরুসিংহে বলুন, ডেভ হোয়াটমোর বলুন, তাদের পর সবচেয়ে সফল কোচ কিন্তু স্টিভ রোডস। তিনি দলটাকে সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কোনো মানুষের শক্তি-দুর্বলতা, সব থাকে। কিন্তু রোডসের কোচিংয়ে ফল দেখেন, বিরাট খারাপ কিছু নেই।

কিছু কথা তাকে নিয়ে বলা হয়েছে। যেমন, বার্মিংহামে প্র্যাকটিস না করে তিন দিন ছুটি দেওয়া (২০১৯ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে লম্বা বিরতিতে)। আমাদের ম্যাচের আগে বার্মিংহামে ভারত-নিউ জিল্যান্ড ম্যাচ ছিল। চাইলেও তো প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড পাওয়া যাবে না, ওই দুই দল করবে প্র্যাকটিস। আমাদের তাহলে অন্য প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড ভাড়া করতে হতো। সেই দায়িত্ব তো বিসিবির! ম্যানেজার বা অন্য যারা ছিলেন বোর্ডের, তারাও তো উদ্যোগ নেননি।

এটা স্রেফ তারা উল্লেখ করেছে। মূল কারণ ছিল (রোডসকে বরখাস্ত করার), দল সেমি-ফাইনালে খেলতে পারেননি। দল যখন সেমিতে খেলতে পারেনি, তাড়াহুড়ো করে বাদ দেওয়া আর নতুন কোচকে মিডিয়া-দর্শকের চাপে তাড়াহুড়ো করে নিয়োগ দেওয়া, দুটিই ভুল সিদ্ধান্ত। এবং কোচকে ইংল্যান্ড থেকে ডেকে এনে তার হাতে চিঠি ধরিয়ে দেওয়া, এটাও অপেশাদারীত্ব। কারণ তিন-চারদিন পরই দল শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছিল। তাকে ওই সুযোগ দেওয়া যেত। শ্রীলঙ্কার পরে অনেক সময় ছিল, তখন ভেবেচিন্তে কোচ নেওয়া যেত।

আপনি কোচকে ডেকে এনে বিদায় করলেন, তখন বলতে হয়, দল বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল খেলতে পারেনি শুধুই কি মাশরাফির জন্য? হয়তো এখন বলতে গেলে কোনো কোনো ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে পারসোনাল হয়ে যাবে, নাম বলব না। কিন্তু ফিল্ডিংয়ের কারণে কি আমরা সেমি-ফাইনাল থেকে বঞ্চিত হইনি? ফিল্ডিং কোচ তো এখনও দলের সঙ্গে আছেন। ফিল্ডিংয়ের কারণে কি আমরা আফগানিস্তানের কাছে টেস্ট হারিনি? ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুটি টেস্ট হারিনি? সেই ফিল্ডিং কোচ এখনও কিভাবে আছে? আপনি কোচকে বরখাস্ত করেছেন, আরেকজনকে করছেন না। এটা তো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।

মাশরাফিকে আপনি ছেটেছেন, এই একজনের ওপর দিয়ে গেলেই ভালো হতো। অন্তত দলটা অস্থির হতো না। দলের কোচ অনেক বড় ব্যাপার। মাশরাফিকে সরানো বড় কিছু নয়। কিন্তু কোচ অনেক বড়। কোচের সঙ্গে সবার মানিয়ে নিতে হয়। আমাদের সংস্কৃতিতে এসব আছেই। একটু সময় লাগা, ভাষার সমস্যা, এসব আছেই। হুট করে একজনকে আপনি আনলেন, যে কিনা একাডেমি-এইচপির চাকরি চেয়েছিল। যার লক্ষ্যই ছিল নিচু জায়গায়, তাকে জাতীয় দলের কোচ বানালেন। লক্ষ্যের ওপরে কাউকে কিছু দিলে সে তো ব্যালান্স করতে পারবে না। তার ফল কি? একটা টি-টোয়েন্টি জিতেছে, ভারতের সঙ্গে।

এখন যখন তাকে এনেছেন, সময়ও দেওয়া উচিত। মিডিয়ার কথায় বা মাশরাফির মতো দর্শকের কথায় বা অন্য দর্শকের কথায় যেন বরখাস্ত না করা হয়। মিডিয়া, দর্শক চাপ দেবেই। এটাই তাদের কাজ।

আপনি ভারতের দিকে তাকান। এক নম্বর এমনি এমনি হয়নি। বোর্ডের সিদ্ধান্ত কাজে না লাগতেই পারে অনেক সময়। কিন্তু স্ট্রং ক্যারেকটার যদি দেখাতে না পারেন, তাহলে হবে না। অনিল কুম্বলেকে যখন বাদ দেওয়া হয়, ভারতের ৫০ কোটি মানুষ মনে হয় তার পাশে ছিল। শচিন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্নন, রাহুল দ্রাবিড়, এমনকি সৌরভ গাঙ্গুলি, সবাই কুম্বলের পক্ষে ছিল। বিরাট কোহলি ও বোর্ডের সিদ্ধান্তে রবি শাস্ত্রি দায়িত্ব পেয়েছে। শাস্ত্রির পেছনে সবসময় মিডিয়া লেগেই ছিল। এখনও লেগে আছে। সেই শাস্ত্রি দলকে কোথায় নিয়ে গেল? কারণ, বোর্ডের মানসিক শক্তি, সিদ্ধান্তহীনতায় না থাকা, বোর্ডের পূর্ণ আস্থা রাখা।

আমাদের এখানে একজন ক্রিকেটারকে নেয়, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়া নেয়। তার পর যখন খারাপ করে, তখন চিন্তা-ভাবনা পরে, আগে ওকে সরা।, বিকল্প কেউ থাকুক বা না থাকুক…।

সাকিব সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি জন্য শ্রীলঙ্কা সফরে না গিয়ে তিনি আইপিএল খেলতে চেয়েছেন। সাকিবের ভাবনা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

মাশরাফি: সত্যি কথা বলতে কী, টেস্টের সঙ্গে টি-টোয়েন্টির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। টেস্ট ক্রিকেট মানে টেস্ট। আমরা তো জানতামই যে বাংলাদেশ ফাইনালে খেলবে না (টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে)। ওই চিন্তা করলে হবে না যে কোনো সুযোগ নেই বলে টেস্ট ক্রিকেটের মূল্য নেই। এটা ভুল ধারণা। সর্বোপরি, বাংলাদেশের ক্রিকেট মানে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এটার সঙ্গে কোনো আইপিএল, সিপিএল আমি অন্তত মেলাতে পারব না। এটা আমার ফাইনাল কথা। সে সাকিব হোক বা অন্য কেউ বা আমি, এটা বাস্তব কথা।

দ্বিতীয় কথা, প্রস্তুতির কথা যখন সাকিব চিঠিতে উল্লেখ করেছে, সে তো অনুমতি চেয়েছে, সে তো বলেনি যে যাবেই! অনুমতি চেয়েছে। বিসিবি অনুমতি দিয়েছে। অনুমতি দেওয়ার পর যখন বিসিবি বলেছে যে সে টেস্ট খেলতে চায় না, তখন পুরো ভুল উপস্থাপনা। কিন্তু বিসিবি যদি এটা বলত যে “তোমাকে অনুমতি দেব না, টেস্ট খেলতে হবে”, তখন যদি সাকিব জোর করে যেত, তখন পুরো ব্যাপার পরিষ্কার হতো। বিসিবি নিজেও তো অবস্থান নিতে পারেনি যে দেশের খেলা আগে!

আরেকটা যেটা বোর্ড বলেছে যে, যারা খেলতে চায় না, খেলবে না। এটা ভালো সিদ্ধান্ত, আমি মনে করি। জোর করে না খেলিয়ে নতুন কাউকে দেখি। এটাও খারাপ নয়। এটা পেশাদারী চিন্তা। বহির্বিশ্বে যদি তাকান, আইপিএলের সময় কোথাও ক্রিকেট হয় না। শুধু বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে হয়। কারণ পাকিস্তানের কাউকে নেওয়া হয় না। বাংলাদেশের মাত্র দুজন সুযোগ পায়। আর সবাই বসে থাকে। তাতে করে সিরিজ আয়োজনের সুযোগ হয়। তখন আবার সাকিব ও মুস্তাফিজের সমস্যা হয়। এখানেও ভাবার চিন্তা।

এখানেও কিন্তু অন্য চিন্তা করা যায়। সবসময়ই কোনো না কোনো পথ আছেই। স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসনরা কি আইপিএল খেলার যোগ্য নয়? ৪০০-৫০০ করে উইকেট পেয়েছে। তারা আইপিএলের দিকে আসে না, কারণ ইসিবি তাদের দেখভাল করে। আইপিএল খেললে যে টাকা পেতে, অতটা হয়তো নয়, মাঝামাঝি কিছু টাকা নাও। ওরা জানে, এই দুজন তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা মোটেও ভুল প্রক্রিয়া নয়। সারাবিশ্বেই এটা চলে। সাকিবকে যদি ওইভাবে সামলান, যে ‘আইপিএল খেলো না বা রেস্ট নাও, আর এই টাকাগুলি রাখো..।”

পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি এজন্য বলছি যে টেস্টের ম্যাচ ফি ১০ লাখ করে দাও, ওয়ানডের ম্যাচ ফি ৬ বা ৫ লাখ করে দাও… কারণ সারাবিশ্বে পারফরম্যান্স এভাবেই বাড়ে। একসময় ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স কিছুই ছিল না । আমাদের কাছে হেরে ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বাদ গিয়ে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে চার বছরের মধ্যে বিশ্বকাপ জিতেছে। এর পেছনের কারণ কি? শাস্তি দিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে? নিশ্চয়ই কিছু পুরষ্কার, কিছু ছোট ছোট পদক্ষেপের কারণে তারা পেরেছে।

সবচেয়ে বড় উদ্যোগ, ওয়েন মর্গ্যানকে তারা অধিনায়কত্ব থেকে সরায়নি। এটা কত বড় আস্থা, ধারণা করতে পারেন? বাংলাদেশ তো চিন্তাও করতে পারবেন না। ঘুমের ভেতরও ঘুম ভেঙে যাবে। আল্লাহ না করুক, তামিমের যদি কয়েকদিন খারাপ যায়, কী অবস্থা হয় দেখেন। আর ওরা, বাংলাদেশের বিপক্ষে হারার পরও অধিনায়ক বদলায়নি। চাট্টিখানি কথা নয়।

শেষ প্রশ্ন, সাকিব মুখ খুলেছে বলেই কি আপনি এত কথা বলার সাহস পাচ্ছেন? নাকি দুজনই পরিকল্পনা করেই করছেন!

মাশরাফি : সাকিবের আগেই আমি বলা শুরু করেছি। সাকিব তো সেদিন রাতে অনলাইনে বলেছে, আমি দুপুরে একটি টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়েছি। ১২টার দিকে। সাকিব যে রাতে এসব বলবে, আমি তো জানতাম না। আমারটা আগে প্রচার হলে হয়তো বলা হতো, আমারটা দেখে সাকিব বলেছে!

আসলে আমরা কেউ কারোটা জানি না। কাকতালীয়ভাবে হতে পারে, লোকে বলতে পারে। কিন্তু সাকিব ওর মতো বলেছে, আমি আমার মতো।

সূত্র:বিডি নিউজ

Advertisement