প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সংগে ভারত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নরেন্দ্র মোদী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তী উদযাপনে যোগ দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থিতিশীল ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম দক্ষিণ এশিয়া গঠনে ভারতকে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বর্তমানে আমাদের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদীজীর ‘প্রতিবেশি সর্বাগ্রে’ নীতির প্রশংসা করি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দশ দিনের জাতীয় অনুষ্ঠানের শেষ দিনের সভাপতির ভাষণে এ কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্মানিত অতিথি হিসাবে যোগ দেন।
ভারতকে এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ দেশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে হলে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা যদি পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদের জনগণের উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই শুভ মুহূর্তে আসুন প্রতিজ্ঞা করি সকল ভেদাভেদ ভুলে আমরা আমাদের জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবো। দক্ষিণ এশিয়াকে উন্নত-সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবো।
নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তাঁর সরকার গত ১২ বছর যাবত বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি।’
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘প্রতিবেশি সর্বাগ্রে’ নীতির প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশি দেশগুলিতে করোনাভাইরাসের টিকা পাঠানোর মাধ্যমে তাঁর এই নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত আমাদের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার।
তিনি আরও বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি ফেনী নদীর উপর মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। এই রাজ্যগুলি এখন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বিমান বন্দর ব্যবহার ব্যবহার করতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি স্বপ্ন দেখতেন অর্থনৈতিক মুক্তির। এজন্য পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা এবং সমতার ভিত্তিতে সহযোগিতার উপর তিনি জোর দিতেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুজিব চিরন্তন’- এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১০-দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আজ শেষ দিন। আপনাদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ৫০ বছর আগে এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জান্তাদের হাতে বন্দি হওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমাদের মধ্যে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে আমাদের আয়োজনকে মহিমান্বিত করেছেন। বাংলাদেশের সরকার, জনগণ, আমার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এবং সেদেশের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই শুভ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্যাদাশীল ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার-২০২০’- এ ভূষিত করার জন্য। আমি মনে করি তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করার মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একজন যোগ্য নেতা এবং গান্ধীজির প্রকৃত অনুসারীকেই সম্মানিত করলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একইসঙ্গে ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য ১০৯টি এ্যাম্বুলেন্স উপহার দিচ্ছে। আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তাঁর সরকার এবং ভারতের জনগণের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে উভয় দেশ বেশকিছু যৌথ কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া এ উপমহাদেশের দুই বরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ভারত সরকার বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছে। আমি এজন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্বশরীরে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে যারা আমাদের অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করেছেন তাঁদেরসহ যেসব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ও সংস্থার প্রধানগণ ভিডিও বার্তা ও শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ নিয়ে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে পথ চলছি, এসব শুভেচ্ছা ও ভিডিও বার্তা তারই বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবোই, ইনশাআল্লাহ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতির পিতার ছোট মেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা জাতিয় প্যারেড স্কয়ারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অভ্যর্থনা জানান।
পরে শেখ রেহানা বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে গান্ধী শান্তি পুরস্কার ২০২০ গ্রহণ করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অহিংসাত্মক ও অন্যান্য গান্ধীবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানিত ‘দ্য গান্ধী শান্তি পুরষ্কার -২০২০’এ ভূষিত করা হয়েছে।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষে ‘মুজিব চিরন্তন’ স্মারক ভাররতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে তুলে দেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি ভøাদিমির পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন জুনিয়র, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেম তায়িপ এরদোয়ানের ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে এর থিম সঙ্গীতের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের লোগো উন্মোচন করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হচ্ছেন পঞ্চম বিশ^ নেতা যিনি এই উদযাপনে যোগ দিলেন।
এরআগে, উদ্বোধনী দিনে ১৭ মার্চ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ এবং তাঁর সহধর্মিনী ফাজনা আহমেদ, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজা পাকসে তৃতীয় দিন, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী ৬ষ্ঠ দিন এবং ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ৮ম দিনে আমন্ত্রিত সম্মানিত অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।