ব্যয় হচ্ছে চার হাজার ২৯৯ কোটি টাকা

বন্দরনগরীর এক্সপ্রেসওয়েতে চলছে না প্রত্যাশিত যান

খরচ উঠতে লাগবে ২৩৫ বছর!

45

বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে আমূল বদলে দিয়েছে শহীদ ওয়াসিম আকরাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, যা দেশের দ্বিতীয় প্রকল্প। নগরীর লালখানবাজার থেকে শহরের ওপর দিয়ে ১৫ কিলোমিটার পথ ধরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত। এ নিয়ে গর্ব করেন চট্টগ্রামবাসী। তাদের এই গর্বের পেছনে রয়েছে হতাশাও। কারণ, চালুর পর প্রত্যাশিত টোল আদায় না হওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করা রাষ্ট্রের অর্থ উঠে আসা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

Advertisement

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। ১৯ দিন আগে টোল আদায়ের মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দাবি করা টোল আদায়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্যয় উঠতে লাগবে ২৩৫ বছর। প্রকল্পটিতে ৫২৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ২০ বছরে যা সুদে-আসলে ৬৫৪ কোটি টাকা শোধ করতে হবে। টোলের টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের পর ঋণ শোধ করতে লাগবে অন্তত ৫০ বছর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোঁজামিলের মাধ্যমে প্রকল্প নেওয়ায় লোকসানি প্রকল্পে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সিডিএ কর্মকর্তাদের দাবি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটিতে বিভিন্ন সড়কের সঙ্গে ওঠানামার ৯টি র‍্যাম্প যুক্ত হবে। এগুলো চালু হলে গাড়ি চলাচল বাড়বে, সঙ্গে টোল আদায়ও।

২০১৭ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নকশাসহ নানা জটিলতায় কয়েক দফা সময় বেড়েছে। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ঋণ দিয়েছে ৫২৪ কোটি টাকা। এই ঋণ ২০ বছরে শোধ করতে হবে। ২ শতাংশ হারে ঋণের সুদ দিতে হবে ১৩০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডের পর ২০২৮ সাল থেকে সুদে-আসলে সিডিএকে ঋণ শোধ করতে হবে ৬৫৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এর মূল অবকাঠামোর কাজ শুরু না হওয়ায় তখনও গাড়ি চলাচল করতে পারেনি। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে পরীক্ষামূলক গাড়ি চলাচল শুরু হয়। গত ৩ জানুয়ারি টোল আদায়ের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ ওয়াসিম আকরাম উড়াল সড়কে’ আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি চলাচল কার্যক্রম উদ্বোধন করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।

গাড়ি চলাচলের পর থেকে প্রত্যাশিত টোল আদায় না হওয়ায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ও টোল আদায় নিয়ে লুকোচুরি করছে সিডিএর কর্মকর্তারা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায়ের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন সিডিএর সিস্টেম অ্যানালিস্ট মোস্তফা জামাল। তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে দৈনিক গাড়ি চলছে প্রায় ৭ হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫ লাখ টাকা টোল আদায় হচ্ছে।

তবে এ দাবি মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত ৩ জানুয়ারি যেদিন টোল আদায় শুরু হয়, সেদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রথম আট ঘণ্টায় যানবাহন চলাচল করেছে মাত্র ৩ হাজার ৪৬২টি। এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতগামী পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও প্রথমদিন টোল আদায় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সেটি এক লাফে ৫ লাখ টাকা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সর্বোচ্চ ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা হতে পারে।

সিডিএর কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী, গড়ে ৫ লাখ টাকা টোল আদায় হলেও বছরে টোল আদায় হবে ১৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে খরচ হচ্ছে, সে টাকা উঠে আসতে সময় লাগবে ২৩৫ বছর। আর শুধু সরকারের ৬৫৪ কোটি টাকা ঋণের টাকা উঠে আসতে সময় লাগবে ৩৬ বছর। টোলের টাকা থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির বিদ্যুৎ বিল, জনবলের বেতন, টোল প্লাজা, নিয়মিত সংস্কারসহ রক্ষণাবেক্ষণে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে টোল আদায়ের মাধ্যমে এই ঋণ ৫০ বছরেও শোধ করা সম্ভব হবে না।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনের করা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা সড়কে প্রতিদিন প্রায় ৮১ হাজার ২৭১টি গাড়ি চলাচল করার কথা ছিল। সে অনুযায়ী অর্ধেক যানবাহনও এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করলে তা হওয়ার কথা ছিল ৪০ হাজারের বেশি। সিডিএর দাবি অনুযায়ী, এখন এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করছে এই সড়কে চলাচল করা যানবাহনের মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এতে করে নগরের যানজট নিরসনের যে উদ্দেশ্যে উড়াল সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে তাতে কোনো প্রভাব পড়ছে না।

প্রকল্পটি নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং সিডিএর নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনুমানের ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর নকশা নিয়ে দফায় দফায় বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও পুলিশের আপত্তির মুখে পড়ে। পরে অন্তত চার দফা নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, গোঁজামিলের মাধ্যমে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থনৈতিক উপযোগিতা বেশি দেখানো হয়। এসবের ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। পরে এসব প্রকল্প মানুষের কোনো কাজে আসে না।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটির পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, কোনো কোনো দিন ১০ থেকে ১১ হাজার গাড়ি চলাচল করে। র‍্যাম্পগুলো নির্মাণের পর পূর্ণাঙ্গ চালু হলে গাড়ি চলাচলের সংখ্যাও বাড়বে। টোল আদায়ও বাড়বে।

তবে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, এই প্রকল্পটা ছিল লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত। তারা কেন লালখানবাজার থেকে ওঠার ব্যবস্থা করল না– এটি অন্যায়। নগরের পূর্বদিকের গাড়িগুলো যদি জিইসি মোড় থেকে উঠতে হয়, তাহলে ওদের পাঁচ কিলোমিটার ঘুরতে হবে। একবার যাবে, একবার আসবে। স্বাভাবিকভাবে এতদূর ঘুরে গাড়িগুলো এই উড়াল সড়কটি ব্যবহার করবে না। পূর্ণাঙ্গ চালু হলেও অধিকাংশ গাড়ি এটি ব্যবহার করবে না।

Advertisement