মাসরুর আরেফিন সাহিত্যের পরিমণ্ডলে যাত্রা শুরু করেন কবি হিসেবে। এই শতাব্দীর প্রথম দিকে। কাব্যগ্রন্থ ‘ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প’ নিয়ে। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে, প্রায় এক দশক পরে, ২০১৩ সালে আবার আবির্ভূত হন ফ্রানৎস কাফকার অনুবাদক হিসেবে। প্রকাশ করেন কাফকার ‘গল্পসমগ্র’। এরপর ২০১৫ সালে আরেকটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ—হোমারের `ইলিয়াড’ অনুবাদ করেন। ২০১৯ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’। যেটি পাঠকসমাজে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। মাসরুর আরেফিন তাঁর ‘আগস্ট আবছায়া’ উপন্যাসের জন্য জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ অর্জন করেছেন। উপন্যাসের কিছু বিষয় নিয়ে তিনি রিফাত মুনিমের সঙ্গে কথা বলেছেন, যা ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের সবচেয়ে কালো একটি অধ্যায়কে ভিত্তি করে আপনি এই উপন্যাস লিখেছেন। আপনি কীভাবে এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরবেন?
মাসরুর আরেফিন : প্রকৃতিগত দিক থেকে ‘আগস্ট আবছায়া’ ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। তবে অবশ্যই এটি ‘পরোক্ষভাবে’ আমাদের জাতির সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি অধ্যায় নিয়ে কারবার করেছে।
আপনি জানেন, উপন্যাস লেখা মূলগতভাবেই একটি কুশলী কাজ। কারণ, আপনি আপনার লেখার ভেতর দিয়ে অন্য লোকদের জীবনে অনুপ্রবেশ করেন। বিষয়টি স্বভাবতই আরও জটিল হয়ে ওঠে তখন, যখন আপনি কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পাশবিক হত্যাকাণ্ডকে ভিত্তি ধরে আপনার কাজ করেন।
আমি ১৯৭৫ সালের সেই গুরুতর রাতে বঙ্গবন্ধুর জীবনে অলক্ষ্যে প্রবেশ করেছি। যেমন ধরুন, আমি কল্পনা করছিলাম, তিনি তখন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। সেই রাতে যখন অনধিকার প্রবেশকারীরা তাঁর বাড়িতে ঢুকল, তিনি তখন কী ভাবছিলেন। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটি কিছুটা নৈতিকভাবে আপত্তিযোগ্য। লোকে সাধারণত বিশ্বাস করে, অন্যের আবেগগত আঘাত ও বেদনা নিয়ে কথা বলা দোষের কিছু নয়। তারা মনে করে, বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বেদনার একটি সাধারণ ভাষা খুঁজে নিতে পারা বা দাঁড় করাতে পারাটা যুক্তিসিদ্ধ এবং লেখকসুলভ কাজ। কিন্তু আপনি যখন মৃত লোকদের স্মৃতিগুলো পুনরায় মাটির উপরে তুলে আনেন, আপনি মূলত মৃতের সাথে একটি ওয়াদার খেলাফ করেন। মৃত লোকটি আপনাকে সবসময় নীরবে একটি সহজ কথা বলতে থাকেন, ‘আমাকে রেহাই দাও, আমাকে ঘুমাতে দাও।’
আপনি যখন বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্ব নিয়ে কাজ করবেন, যিনি জীবিতর চাইতেও বেশিকিছু, তখন এটি একটি বড় নৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠে। আপনি এমনভাবে তাঁর যন্ত্রণাভোগ কল্পনা করে তাঁকে বিরক্ত ও নির্যাতন করেন, যেন তা জনপরিসরেরই বিষয়। এবং যেহেতু তিনি মৃত, তিনি একে প্রতিহত করতে পারছেন না, কিছু বলতে পারছেন না। আপনি গদ্যকে ছন্দময় করে তা আপনার পাঠকের কাছে আবেগগতভাবে আরও কার্যকর করার চেষ্টা করছেন। সত্যিকার অর্থে গীতিধর্মীতা নিজেই মানুষের ‘আত্মা’ সম্পর্কে পবিত্রতার লঙ্ঘন। আমরা এমন একজন সম্পর্কে বলছি যিনি খুন হয়েছেন, অসহায়ভাবে মারা গেছেন। সেখানে কিনা আপনি আপনার জায়গা থেকে এই ঘটনাকে কিছু মনোরম গদ্য দিয়ে শুরু করেছেন। যেন সেসময় মেঘের আড়ালে চাঁদকে কেমন দেখাচ্ছিল। ওহ! এটি একটি অসার আত্মশ্লাঘার কাজ হতে বাধ্য।
প্রশ্ন : তাহলে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সেইসব বীভৎস ঘটনা বর্ণনায় আপনি কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন?
মাসরুর আরেফিন : আমি যেমন বলেছি, আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক রাত সম্পর্কে লেখা, অসার আত্মশ্লাঘার সাথে বিপর্যয়কর রকম দুর্ভাগ্যের। কাজেই, আমার ভাবনা ছিল পুরো বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে, যেকোনো ধরনের স্থূল অনুপ্রবেশ এড়ানো যায়। কিন্তু বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে এসে (২০১ থেকে ২৪৫ পৃষ্ঠা) আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। আপনি হয়তো বলবেন, এটি সৃজনশীল লেখা। তবে বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর কবর থেকে উঠে আসেন, তিনি হয়তো বলবেন, ‘এগুলো সব বাজে কথা। এই লেখক আমাকে যেভাবে তুলে ধরেছে, আমি একেবারেই সেরকম ছিলাম না।’
আপনি যখন কারো বিষয় নিয়ে বলতে কল্পনা করেন, আপনি এক রকম নিজের সৃষ্টি করা ঘূর্ণিপাকের মাঝে প্রবেশ করেন। একজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে কারবার করা যিনি মারা গেছেন, একই সময়ে শুধু তাঁর পরিবারের সবার মৃত্যু নিয়েও বলতে গেলে, যদি আপনি নিজেই নিজের সময়ের বয়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছু অতিরিক্ত সংবেদনগত অনুভাবনা না রাখেন, তাহলে সততার সাথে এটি করা যেতে পারে না। এখানে সময় আপনাকে রক্ষা করে। এবং সময়ের অতিক্রমে সবশেষে আপনি কিছুটা মুক্তির স্বাদ অনুভব করবেন।
এই কারণেই লেখকরা এখনো হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লিখতে পারেন। তারা পরোক্ষভাবে শুরু করেন। কিন্তু সেভাবে তারা বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। বরং তারা ঠিক বিপরীত দিকে ঝোঁকেন, যেটি সরাসরি। তথাকথিত সরাসরি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবশ্যই অনেক ভালো ব্যাপার বলা যায়। তবে এখানে একটি ফ্যাক্ট আছে। তা হলো, ঐ ধরনের কাজে অন্ধকার দিকগুলো রয়ে যায়।
প্রশ্ন : আপনি কি ‘আগস্ট আবছায়া’কে কিছু মাত্রায় ঐতিহাসিক উপন্যাস বলবেন?
মাসরুর আরেফিন : আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, ‘আগস্ট আবছায়া’কে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে বলার চেষ্টা আছে। কিন্তু সত্যি কি তাই? এটি নিশ্চিতভাবেই সেধরনের কিছু নয়। অর্থাৎ, যেভাবে করা হয়েছে সেভাবে কেন হলো এটি তার নিজস্ব ভার্সন নয়।
আমি মনে করি, নির্দিষ্ট ক্যাটেগরিতে বই রাখার সুবিধায়, আমরা ‘আগস্ট আবছায়া’কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলি। আর তা ঠিক এ কারণে যে, হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটি এই উপন্যাসের কেন্দ্র বিন্দু। কিন্তু কেন্দ্রবিন্দু কেবল একটি কেন্দ্রবিন্দু। আসলে যেকোনো কেন্দ্রের বাইরে বৃহত্তর একটি পরিধি আছে। সেখানে অনেক কিছু ঘটে। আপনি যদি নিবিড়ভাবে দেখেন, এই কেন্দ্র আসলে শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাপার। এটি কোনো আবেগ বা বিচারকে প্রশ্রয় দেয় না। এটি কেবল বলে, বুদ্ধিমান এই প্রজাতিটি বহু সহিংস কাজে লিপ্ত থাকার জন্য দায়ী। ঠিক এটাই। কিন্তু উপন্যাস বা সৃজনশীল লেখায় আপনি এর চাইতে বেশি কিছু চান। আপনি চান মানুষের জীবন কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে পুনঃসৃজিত হোক। কাজেই, স্ববিরোধটা এখানেই—আপনাকে কিছু অর্জনের জন্য অবশ্যই কেন্দ্র ছাড়িয়ে, কাজের বাইরের দিকের পরিধিতে যেতে হবে।
বিষয়বস্তুর পরিধির প্রান্তসীমার কাছে উপন্যাস আবির্ভূত হয়। আমি এইসব বলছি শুধু এটা তুলে ধরার জন্য যে, এ রকম একটি বিশেষ অন্ধকার অধ্যায় নিয়ে কাজ করা একজন লেখকের প্যাশন। রাজনৈতিকভাবে বললে যার ভাবাদর্শিক এবং অহমগত দিক রয়েছে, আরও বেশি নিজস্ব অন্ধকার দিক রয়েছে।
প্রশ্ন : একটি দেশের ক্ষমতাসীন একজন প্রেসিডেন্টের পরিবারের প্রায় সবাই নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। এই রকম একটি রক্তাক্ত ঘটনা নিয়ে লিখতে কী আপনাকে উৎসাহিত করেছে?
মাসরুর আরেফিন : আমি স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। জাতির যৌথস্মৃতি নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি। যেটি আমার মাথায় চিরতরে আটকে গেছে। সেসময় আমি মাত্র ছয় বছরের এক বালক। আমি কিছুটা অস্পষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন্ন বরিশালের একটা সকাল স্মরণ করি। তখন আমার বাবা—বঙ্গবন্ধুর চেহারার সাথে তাঁর মিল ছিল—তাঁর এক বন্ধুর সামনে ভয়ে কাঁপছিলেন এবং কান্না করছিলেন। একইসাথে আমার মনে পড়ে, সেখান থেকে দৌড়ে আমাদের ঘরে ফিরে এসেছিলাম। আমার মনে পড়ে, স্মৃতি বয়ে বেড়াতে আমার জন্য এটুকুই অনেক বেশি ছিল। আমার বাবা কাঁদছেন, এই স্মৃতি আমার রয়ে গেছে। এবং চিরদিনের জন্য বয়ে বেড়াতে এটুকু যথেষ্ট।
দেখুন, দৈহিক ব্যথার একটি সীমা আছে। কারণ, আপনি আপনার চেতনা হারাবেন। কিন্তু মানসিক ব্যথার কোনো শেষ নেই। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তার ব্যথা সামলাতে ঘুমের বড়ি খায়। কারণ, এই ব্যথা তাকে দীর্ঘ অনিদ্রায় নিক্ষেপ করে। ফ্যাক্ট হলো, লোকেরা সাধারণত নীরবে যন্ত্রণা ভোগ করে। উপন্যাসে নায়ক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুবই সচেতন যে, প্রত্যেকে যন্ত্রণাভোগ করছে। তিনি জানেন, এখানে কোনো যিশু নেই—যে যিশু আমাদের যন্ত্রণা দূর করেছিলেন—কোনো ধর্মতন্ত্র নেই যেটি অ্যাসপিরিনের বদলে কাজ করতে পারে।
আপনি উপন্যাসে এই বোধটা পাবেন, আমরা প্রত্যেকেই এক ধরনের মানসিক হাসপাতালে বাস করি। মানে আমি বলতে চাই, আমরা এমন একটা প্রজাতি যারা সবসময় ব্যথার মাঝে, দুর্দশার মাঝে থাকি। কাজেই, বইয়ের মাঝেও নায়ক সবসময় তার কঠিন অবস্থার মাঝে থাকে। সে বেঁচে থাকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক জগৎ এবং অস্বাভাবিকভাবে ‘সহিংস’ বীভৎস জগতের মাঝে সীমারেখার ওপর। এর সবই আমাদের চিরকালীন মৃত্যু মিছিলের বিষণ্ণ গান গায়। এর ফাটল রেখাটা ঠিক আমাদের মানসিক ও দৈহিক অবস্থার ভেতর দিয়ে চলে। দৈহিক অবস্থা আমাদের বলে, আরে এগিয়ে চলো। মানসিক অবস্থা বলে, স্মৃতি একটি ভারী বোঝা। আমাকে ছেড়ে দাও। দুটো টেকটোনিক প্লেট পরস্পরের বিরুদ্ধে আঘাত করে। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের স্মৃতি। এই দুই অবস্থার মাঝে আপনার বেদনার উৎস। আপনি একে চেপে রাখতে পারেন। কিন্তু এ থেকে আপনি পালাতে পারবেন না।
অবশ্যই আমার অনুপ্রেরণার উৎস ছিল সহজ ও নিখাদভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা। যিনি পাকিস্তানিদের এই ভূমি ত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু ভাবুন, বঙ্গবন্ধু তখন একজন অজনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ইতিহাসের এমনতর ম্যাকিয়াভেলীয় প্রত্যয়, মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের একটি ঝাপসা অনুভূতি দেয়, যেটি আমরাই সৃষ্টি করেছি। আমি এ বিষয়ে কখনো আগ্রহী ছিলাম না।
আমি আগ্রহী ছিলাম দৈহিক ও মানসিক যাতনার টেকটোনিক প্লেটের মাঝখানে কীভাবে স্মৃতি আসে, সে সম্পর্কে গভীরে যাওয়ার ব্যাপারে। আমার বইয়ে আমি সেই যাতনাগুলোর একটি সাধারণ কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। যেমন ভাবা হয়েছে, এক্ষেত্রে সেটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। এবং প্রধান চরিত্র’র মনে করার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তা যাতনাভোগ করেছে। প্রধান চরিত্র পরে একে যাতনাভোগের প্রপঞ্চের মাঝে নিয়ে যায়। যেটি সবার জন্য নির্বিশেষে প্রয়োগযোগ্য। যারা বঙ্গবন্ধুকে
গ্রাহ্য করেন অথবা যারা করেন না। উপন্যাসের ফর্মে এবং একটি নতুন উত্তরাধুনিক ভাষায়, ১৯৭৫ এর রক্তাক্ত ঘটনার ভেতর থেকে এই ধরনের একটি প্যারাডাইম বা প্রপঞ্চ সৃষ্টি করা ছিল আমার মূল প্রেরণা।
প্রশ্ন : উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হিংস্র বর্বরতা। তবুও এই উপন্যাস সাহিত্য থেকে দর্শন, দর্শন থেকে বিজ্ঞানবিষয়ক বইপত্রের রেফারেন্সে ভরপুর। ইতিহাসে পৌঁছুতে সোজা রাস্তার পরিবর্তে এই জটিল ঘুরপথ নিলেন কেন? এটি কি বাস্তবতা মোকাবিলায় একটি স্টাইলসংক্রান্ত পছন্দ ছিল?
মাসরুর আরেফিন : সম্ভবত ‘লর্ড জিম’–এ জোসেফ কনরাড বলেছিলেন, সত্যকার ইতিহাস হলো সেই ইতিহাস যা একজন উপন্যাস-লেখক কল্পনা করেন। মানে নথিপত্রভিত্তিক ইতিহাস নিখাদ নথিপত্র, ইতিহাস নয়। আমি ইতিহাসবিদ নই। আমি উপন্যাস-লেখক। কাজেই, আমাকে প্রধান সড়কের দিকে যেতে অবশ্যই অন্য অনেক মহাসড়ক এবং পার্শ্বরাস্তা অতিক্রম করে যেতে হবে। নয়তো মৃতের ওপর যে সহিংসতা চালানো হয়েছে তা আরও অনেক বেশি হয়ে যাবে। তা হবে ব্লাসফেমি এবং অপবিত্রতার মতো একটি কাজ। আর তাই, আমাকে প্রচলতি রীতি থেকে সরে তির্যক বা পরোক্ষভাবে বলতে হয়েছে। আপনি যেমন বলেছেন, পথ ঠিক অতটা জটিল বা প্যাঁচালো নয়। এটি বরং তির্যকভাবে বলা।
অন্য আরেকটি কারণ হচ্ছে আমি সময়কে ধরতে চেয়েছিলাম। এই কারণেই প্রধান চরিত্র সেই ভয়াবহ দিনের মাঝে প্রবেশ করে, যেন সবকিছু তার সামনে ঘটছে। ব্যাপারটা হলো, উপন্যাস শিল্পের একটি ফর্ম যে সর্বদা সময়ের মাঝে গতিশীল। এটি সর্বদা সময়ের প্রান্তের দিকে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়, এবং এটি ঋণাত্মক ঢালের ওপরে কাজ করে। সময়ের বয়ে যাওয়াকে ধরা খুব কঠিন। আমার গবেষণার অংশ হিসেবে আমি যখন সেই হত্যাদৃশ্য পুনরায় দেখছিলাম, যেটি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাড়ি, সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করছিলাম, আমাকে অন্য একটি সময়ের মাঝে নেয়া হয়েছে। ধরুন, এই একই ব্যাপার ঘটে যখন আপনি কোনো আর্ট গ্যালারিতে ক্লদ মোনে’র চিত্রকর্ম দেখবেন—আপনি মোনে’র সময়ের মাঝে ভ্রমণ করবেন। এটি আপনাকে পুনরুদ্ধারের একটি বোধ দেয়। যেহেতু আপনি সময়ের বয়ে যাওয়া থেকে আলগা হওয়া অনুভব করেন।
সেই ঘরে বুলেটের গর্তচিহ্ন দেখে আমার একই রকম বোধ হয়েছিল। এবং আমি সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলাম, আক্ষরিক অর্থে এটাই সময়ের মাঝে পরিভ্রমণের পথ। যেহেতু সেই পদক্ষেপ তার স্বভাবেই সরাসরি, তাই আমাকে ভারসাম্য রক্ষার জন্য অবশ্যই প্রথমে বইয়ের জগতে পরিভ্রমণ করতে হয়েছে।
আমি একইসঙ্গে উপন্যাসে এশীয় মহিষের মতো প্রতীকের ব্যবহার করতে চেয়েছি, যেটি সহিংসতাকে চিত্রিত করবে। স্বভাবের নিরঙ্কুশ চলন চিত্রিত করতে আমি এই একই প্রতীকের ব্যবহার করতে চেয়েছি, যেখানে একজন মানুষের মৃত্যু ছেঁদো হতে পারে না। এই সবকিছুর ফলে গল্পটিকে তির্যক করে তোলা অপরিহার্য ছিল। কাজেই, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট কিছু বইয়ের ভেতর দিয়ে গেলে আপনি দেখবেন, সেখানে মানুষের স্বভাবের অভিন্নতা এবং নিষ্ঠুরতা নিয়ে কারবার করা হয়েছে।
প্রশ্ন : আপনি হোমারের ‘ইলিয়াড’ এবং কাফকার সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এই উপন্যাসের বর্ণনাকারী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের অধ্যাপক। সেও এই একই লেখকদের লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছে। এভাবে একদম প্রথম অধ্যায় থেকেই আত্মপ্রতিচ্ছবির অনেক উপাদানই সুস্পষ্ট। যেটি পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে একটি সূত্র হিসেবে দেখা গেছে। এটি কি সচেতন পছন্দ ছিল নাকি উপন্যাসটি লেখার সময় এসে গেছে?
মাসরুর আরেফিন : আমি তৃতীয় পুরুষের সর্বজ্ঞ বর্ণনায় আস্থা রাখি না। যেটি সবসময় আমার কাছে ভুয়া হিসেবে হাজির হয়। আমি একমত, উপন্যাস লেখার পুরো ব্যাপারটাই অনুকৃতি। তবুও উত্তম পুরুষে বলা কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদান করে। এটি বলার তলস্তীয় ধরনের চাইতে উচ্চতর সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে। অন্য ধরনগুলো যে উপন্যাসপাঠের আকাঙ্ক্ষা নষ্ট করে তার কারণ, সব চাক্ষুষ করা শক্তিশালী বর্ণনাকারী একে অতি পষ্ট এবং অতি বাস্তব তৈরি করে।
অনুকৃতির ধারণাটা গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসে আপনি বাস্তব জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করতে চান। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাস্তব জীবন কখনো বাস্তব হতে পারে না, যেহেতু কেউ একজন হিসেবে আপনি একে যা বাস্তব তার কল্পনার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি করছেন। সুতরাং, আপনার আখ্যান বর্ণনা ব্যাপক মাত্রায় অনির্ভরযোগ্য হতে বাধ্য। বলার কোন ধরন আপনি বেছে নিয়েছেন তা কোনো ব্যাপার নয়। তবু আমি অনুভব করি, আমার উপন্যাসে আমি যখন ‘আমি’ হিসেবে কথা বলি, আমি আরও বুদ্ধিদীপ্তভাবে এই বিভ্রান্তিকর অনুকৃতির খেলা নিয়ে খেলি। ঠিক যেন আমি আমার সত্য আর মিথ্যা বলার ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণ করছি। কারণ, এটি প্রতিদিনকার বলা একটি ‘আমি’।
তাছাড়া ‘সে’র চাইতে ‘আমি’ আরও অনেক বেশি সীমাবদ্ধভাবে বিষয়গুলো দেখতে পারে। ধরুন, ‘আমি’ যখন দৈহিকভাবে বালুরমাঠে উপস্থিত, ‘আমি’ তখন ধানমণ্ডি ৩২ এর দৃশ্য বর্ণনা করতে পারে না। স্মরণীয়, আগস্টের
১৪ তারিখ রাত ৮টায় বালুরমাঠে জওয়ানদের ব্রিফ করা শুরু হয়েছিল। ‘আমি’র এই সীমাবদ্ধ দৃষ্টি, ‘সে’র সবদেখা দৃষ্টির চাইতে অনেক বেশি সত্য।
একইসঙ্গে এই রকম একটি ব্যক্তিগত গল্প বলার উদ্দেশ্যের জন্য, কল্প-কাহিনি তৈরি করা থেকে যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা আমার দরকারি ছিল, যেখানে কিনা শক্তিশালী ৪০০ পুরুষ সৈনিক কয়েকজন অসহায় ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। আমার জন্য দরকারি ছিল লেখক ও পাঠকের মাঝে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেবার। উত্তম পুরুষে বর্ণনা এখানে আমাকে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন : প্রচুর বইপত্রের উল্লেখ এবং বহু সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আলাপের ভেতরে প্রবেশের ফলে অনেক সময় উপন্যাসিক ফর্মের সূত্র হারিয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। এই চ্যালেঞ্জ আপনি কীভাবে সামাল দিয়েছেন?
মাসরুর আরেফিন : মূলসূত্রের কাছাকাছি থাকার কৌশল আমি শিখেছি কনরাড, ডাব্লিউ. জি. সিবাল্ড, অমিয়ভূষণ, মারগুরি ইউসেনার, ভি. এস. নাইপল, জোসেফ রথের মতো ওস্তাদদের কাছ থেকে। এই ছয়জনের সবাই তাদের প্লটের কেন্দ্রে আসেন বেশকিছু ঘোরাঘুরির পরে। একে আপনি বাইরের পরিধি বলতে পারেন। এটা করার জন্য চরিত্র এবং ঘটনাবলির উপবিভাগ টুকে নেয়ার সাথে সাথে, পরিষ্কারভাবে বিস্তারিত নোটবুক প্রয়োজন হয়েছিল। আমার ৪৫৫ পাতার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির জন্য ১০০ পাতার মতো নোটবুক লেগেছিল।
প্রশ্ন : উপন্যাস অথবা অনুবাদের মাঝে আপনি কোনটা বেশি পছন্দ করেন? নাকি দুটোই সমানভাবে উপভোগ করেন?
মাসরুর আরেফিন : সময় এবং শক্তির নিরিখে, এই বয়সে আমি আমার নিজস্ব উপন্যাস লেখাকেই সময়ের উত্তম ব্যবহার মনে করি। দেখুন, হোমারে এর সবই আছে। অন্যদিকে কাফকা ভিন্ন সংবেদন ও রঙ নিয়ে এই একই হোমারীয় ট্রাজিক জগতের পুনঃসৃজন করেছেন। চটকদার বাংলা গদ্য নয়, ভালো লেখার শিল্প আয়ত্তের জন্য আমার দরকার ছিল এই দুই ওস্তাদের কাজ অনুবাদ করা। আমার মনে হয় না, আমার আরেকটা অপ্রধান বা অধস্তন কাজে যুক্ত হয়ে যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতা নেয়ার দরকার আছে—যাকে আমরা বলি অনুবাদ।
প্রশ্ন : উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস লেখকদের জন্য পরামর্শ নিয়ে কিছু বলবেন কি?
মাসরুর আরেফিন : একজন নতুন লেখককে অবশ্যই তার নিজের কাছে প্রশ্ন করতে হবে, কেউ কেন আমার বই পড়তে আগ্রহী হবে? এর উত্তর আছে স্থান ও কালের ইতিহাসের সাথে মানুষের ব্যক্তিগত গল্পগুলোকে সম্পর্কিত করার ক্ষেত্রে আপনার সামর্থ্য অসামর্থ্যের মাঝে। মানে আমি বলতে চাই, একটি ব্যক্তিগত গল্পে যদি ঐতিহাসিকতা না থাকে, লোকে আমার গল্প পড়বে কেন, যখন কিনা তারা মহাখালি রেলগেটের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে মানুষের জীবন দেখতে পারে?
এর সাথে আমি আরও যোগ করতে চাই, যেহেতু একটি মেজাজ আরেকটি মেজাজকে জায়গা ছেড়ে দেয়, তন্দ্রায় থাকা চেতনার প্রতি সচেতন হোন। আমাদের প্রতিদিনকার অস্তিত্বের অবান্তর অর্থহীনতা এবং তুচ্ছ নগণ্য জিনিসের সাথে আলিঙ্গনে মনোযোগী হোন। আমাদের জীবন-কাহিনির অনিশ্চয়তার প্রতি সচেতন হোন। সবশেষে, ‘সমাপ্তি’ কোনো কিছুর সমাধা করে না, ঐতিহ্যগত অর্থে তা কোনো সমাধান দেয় না। কিন্তু তা ‘সমস্যা’কে সত্যিকারভাবে চিত্রিত করে।