অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বিসিএস ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডে চাকরি বাগিয়ে নেওয়া, প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, হত্যাসহ নানা অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালের একটি খুনের মামলার প্রধান আসামি বিদ্যুৎ বড়ুয়ার সব অপকর্মের খুঁটির জোর ছিলেন তার ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। ভাইকে ব্যবহার করে এহেন বহুমাত্রিক দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে ওঠেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া।
জানা গেছে, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) তাদের পাবলিক হেলথ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার জন্য ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়াকে একটি লিখিত প্রস্তাব দেয়। এমন একটি চিঠিকে যোগ্যতা দেখিয়ে ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক পদে (পঞ্চম গ্রেডে) চাকরি বাগিয়ে নেন। ২০২০ সালে ওই চাকরি নেওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৪৫ বছর। জনবল কাঠামোতে না থাকা সত্ত্বেও উপাচার্য ডা. মো. ইসমাইল খানকে দিয়ে করিয়ে নেন অফিস আদেশ। ওই আদেশ অনুযায়ী বিদ্যুৎ বড়ুয়া হন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুখপাত্র।’
মূলত, এআইইউবি থেকে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হলেও বিদ্যুৎ বড়ুয়া সেখানে কখনও চাকরি করেননি। আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব বড়ুয়ার চাপেই এআইইউবি ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরি করার জন্য ওই লিখিত প্রস্তাবনা (অফার লেটার) দেয়।
এআইইউবির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান আবু মিয়া আকন্দ তুহিন বলেন, বিদু্ৎ বড়ুয়া চট্টগ্রামের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন- এ কথা জানিয়ে বিপ্লব বড়ুয়া একটা অফার লেটার দিতে আমাদের চাপ দেন। সেটা নেওয়ার পর বিদ্যুৎ বড়ুয়া আর এই ক্যাম্পাসে আসেননি। এর আগেও কখনও এআইইউবির সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না।
জানা যায়, এআইইউবির ওই অফার লেটার দেখিয়ে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ বড়ুয়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। দিনে দিনে তিনিই হয়ে ওঠেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিখিত প্রধান ব্যক্তি। পেছনে শক্তি হিসেবে ছিলেন ভাই বিপ্লব বড়ুয়া।
মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ বড়ুয়ার চাকরি স্থায়ী ও বৈধ করতে ২০২৪ সালের ১৯ জুন জারি করা হয় রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপন। এ সময় উপ-পরিচালকের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তাকে ‘চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পেরও উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন ও সমন্বয়) করা হয়। সাধারণত একজন প্রকৌশলী এ ধরনের দায়িত্ব পালন করার নিয়ম থাকলেও বিদ্যুৎ বড়ুয়ার জন্যই পদটি সৃষ্টি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, ‘এআইইউবিতে আমি খ-কালীন প্রভাষক ছিলাম। সেটা এখানে বলার মতো কিছু নয়। আমার বিরুদ্ধে অযোগ্যতার যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মতো এ রকম অনেকেই আছেন। সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের বোন এবং ডা. আফছারুল আমীনের ছেলেও কোনো যোগ্যতা ছাড়াই এখানে চাকরি পেয়েছেন।’ মুখপাত্র প্রসঙ্গে বলেন, ‘একজন উপাচার্য সব বিষয়ে সবার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। এ জন্য আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।’
জানা গেছে, বিদ্যুৎ বড়ুয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন। ডাক্তার হিসেবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে সনদ পান ২০০৩ সালে। ১৯৯০ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরি স্থায়ী হয়। সরকারি চাকরিতে যোগদানের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছরের নিয়ম এখানে মানা হয়নি। একজন বিসিএস ক্যাডার নবম গ্রেডে চাকরি শুরু করেন। অতীতে কোনো চাকরি না করে কিংবা কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বড়ুয়া পঞ্চম গ্রেডে চাকরি নিয়ে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতির উদাহরণ তৈরি করেছেন বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. ওমর ফারুক ইউসুফ বলেন, বিদ্যুৎ বড়ুয়ার চাকরি এখানকার কোনো নিয়ম মেনে হয়নি। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে হয়েছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ১৪ বছর বয়সে এসএসসি পাস করেছি। ৪৫ বছর বয়সে আমার চাকরি হয় অস্থায়ী ভিত্তিতে, পরে স্থায়ী করা হয়। বাবা শিক্ষক ছিলেন বিধায় আমার লেখাপড়ার সঙ্গে বয়সের বিষয়টি নিয়ে সতর্ক ছিলেন।’
উপ-পরিচালক হিসেবে চাকরিতে যোগ দিলেও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছিল তার বিশেষ নজর। অভিযোগ রয়েছে, এ সংক্রান্ত ব্যাপক খরচপাতি দেখিয়ে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘রাইট টু প্রাইভেসি’ বিধানের বলে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে (ঢামেক) ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে ডা. ফজলে রাব্বি হলে কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল আসাদ রাজীব খুন হন। ওই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেটা ছিল শিক্ষাঙ্গনে প্রথম রাজনৈতিক খুনের ঘটনা। এই ঘটনার পর বিদ্যুৎ বড়ুয়া ভারত হয়ে ইউরোপে পালিয়ে যান। ডেনমার্কে টানা ১০ বছর আবাসিক হোটেল ও সবজির দোকানে কাজ শেষে ২০১৯ সালে দেশে আসেন। ততদিনে তার বড় ভাই ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিলে রাজীব হত্যা মামলাটিও প্রত্যাহারের চেষ্টা করেন বিপ্লব বড়ুয়া। কিন্তু ঢামেক ছাত্রলীগের প্রতিরোধের মুখে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বর্তমানে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত (কোয়াশম্যান্ট) আছে।
বিদ্যুৎ বড়ুয়া দাবি করেন, ঘটনার দুই বছর আগেই তিনি ইউরোপ যান। তাকে শত্রুতা করে এই মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে।
ফিল্ড হাসপাতাল : করোনাকালীন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে এক শিল্প গ্রুপের জায়গায় ৪০ শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল খুলেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। সেই হাসপাতাল চালাতে বিপ্লব বড়ুয়ার ছোট ভাই পরিচয় দিয়ে ব্যক্তি ও বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ থেকে আসতে থাকে টাকা। ওই ফিল্ড হাসপাতালের এক সহ-উদ্যোক্তা জানান, নগদ টাকা, চেক ও বিকাশের মাধ্যমে ওই সময় অনুদানের টাকা পাওয়া গেছে ১৫ কোটি। অঙ্গীকার সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বড়ুয়া কোনো হিসাব দেননি। সাজ্জাত হোসেন নামে একজন বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে লেখায় উল্টো তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছয় মাস জেল খাটান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ফিল্ড হাসপাতালে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়। এ ছাড়া হাসপাতালের নামে পাওয়া অনুদানের টাকায় ২০২০ সালে বিদ্যুৎ বড়ুয়া চট্টগ্রামের অভিজাত আবাসিক এলাকা খুলশিতে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। ওই সময়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়ার দৃশ্যমান আয়ের উৎস ছিল না। অথচ এক চেকেই ফ্ল্যাটের জন্য ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ফ্ল্যাট বিক্রেতা ও বিএনপি নেতা মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিদ্যুৎ বড়ুয়া করোনাকালীন নগদ টাকা ও চেকে ফ্ল্যাট কেনেন। সেই চেকের জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করি। এখন বিদ্যুৎ বড়ুয়ার কারণে আমার অ্যাকাউন্টেরও লেনদেন স্থগিত রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার।’
তবে ফ্ল্যাট কেনার বিষয়ে বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, ‘আমি তখন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতাম। তা ছাড়া আমি তো ফকিরের ছেলে না। বাবা আইনজীবী ছিলেন।’
বিদ্যুৎ বড়ুয়া নিজেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলে পরিচয় দিয়ে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিলেও এ সংক্রান্ত কোনো ডিগ্রিই তার নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা হলো মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ (এমপিএইচ) ডিগ্রি নেওয়া। এ ডিগ্রি নিতে চার বছর লাগে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) ২০২২ সালে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। এ আবেদনের সপক্ষে তিনি কিছু কাগজপত্রও জমা দেন। কিন্তু বিএমডিসি এসব কাগজপত্রের স্বীকৃতি দেয়নি।
গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, দুটি তালা দিয়ে ৩১২ নম্বর কক্ষটি নিজে তালাবদ্ধ করেছেন বিদ্যুৎ বড়ুয়া। নিজের নামফলকটিও ভেঙে ফেলেছেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে তিনি পলাতক। এর মধ্যে সাবেক উপাচার্য ডা. মো. ইসমাইল খানের কাছে গত ১৯ আগস্ট অসুস্থতার জন্য দুই মাসের ছুটির আবেদন করেন। ইতোমধ্যে আবেদনের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. ওমর ফারুক ইউসুফ বলেন, বিদ্যুৎ বড়ুয়ার ছুটি ১৯ অক্টোবর শেষ হওয়ার পরও দাপ্তরিক কাজে হাজির হননি। তার সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, ‘তিন চারটা মামলা খেয়েছি। চাকরিতে আসব কী করে? আমি রেজিস্ট্রি করে ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়েছি। ছয় মাসের ছুটি টানা নেওয়া যায়।’